পঞ্চগড়-২ : হিন্দু ভোট কে পাবে, বিএনপি না জামায়াত?

এসকে দোয়েল, পঞ্চগড়
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৮:০১

গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা উঠান বৈঠক, পথসভা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৈঠক ও প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচনী লড়াইয়ের খবর জানাতে এবার থাকছে পঞ্চগড়-২ আসন নিয়ে বিশেষ আয়োজন।
বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত পঞ্চগড়-২ আসন। এ আসনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ড কমিটি থেকে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনে চলছে ব্যাপক তৎপরতা। দীর্ঘ চারটি নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভোটারদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। পছন্দের প্রার্থীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগে নির্বাচন নিয়ে চায়ের টেবিল থেকে সর্বত্র চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, আসনটিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪১ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭১০, নারী ১ লাখ ৯৪ হাজার ২২৮ এবং তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ভোটার ছিলেন মাত্র তিনজন। হালনাগাদ তালিকায় মৃত ভোটার বাদ দেওয়ার পর এ আসনে ভোটার বেড়েছে ১৩ হাজার ২৬৭ জন। এর মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটার এক লাখের বেশি। তরুণ ভোটারের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো।
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির কামিজ উদ্দিন প্রধান। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে মোজাহার হোসেন এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও পরে তিনি যোগ দেন বিএনপিতে। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুল ইসলাম সুজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তিনি এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পঞ্চগড়-১ আসনের মতোই ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ আসনটিও আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। টানা চারবার নির্বাচিত হওয়া আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন বর্তমানে কারাগারে আছেন।
২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা আসনটি এবার পুনরুদ্ধার করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে বিএনপি। তবে আসনটিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরিতে তৎপর জামায়াতও। অনেকে মনে করছেন, এ আসনে মূল লড়াই হতে পারে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় নেতাকর্মীদের অনেকেই ঘর ছাড়া। ফলে রাজনৈতিক মাঠ এখন আওয়ামী লীগশূন্য। মাঠে এখন বিএনপির পল্লি উন্নয়ন সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সদস্যসচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ, জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য সফিউল্লাহ সুফি, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শিশির আসাদসহ একাধিক প্রার্থী।
এছাড়া কেন্দ্রীয় জাগপার সহসভাপতি তাসমিয়া প্রধান জুঁই, বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পঞ্চগড় জেলা সভাপতি অধ্যাপক এমরান আল আমিন, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের তরুণ নেতা মীর আমির হোসেন আমু, জাকের পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, খেলাফত মজলিস প্রমুখ দল থেকেও প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিএনপি থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা না হলেও দলের একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন ফরহাদ হোসেন আজাদ। বিগত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া এ নেতা জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে তৃণমূল পর্যায়ে আরও সক্রিয় হয়েছেন। নিয়মিত তার নির্বাচনী এলাকায় উঠান বৈঠক, সভা-সেমিনারসহ কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা মাসুদ রানা রিয়াজও মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে এ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তাদের প্রার্থী সাবেক বোদা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সফিউল্লাহ সুফি মাঠে সরব। তিনি আগে কৌশলে বিভিন্ন দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে রেখেছিলেন। বর্তমান অনুকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের মতো করে দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। প্রতিদিন জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় উঠোন বৈঠক ও সভা-সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সমাজসেবক ও লেখক শিশির আসাদের নাম শোনা যাচ্ছে। তবে তিনি জানিয়েছেন, এখনো দলীয় কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
এছাড়া বাংলাদেশ জাসদের জেলা সভাপতি এমরান আল-আমিন, ইসলামী আন্দোলনের কামরুল হাসান প্রধান, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপার ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান, জাকের পার্টির শাহ আলম, সিপিবির আশরাফুল ইসলাম প্রমুখের নামও আলোচনায় রয়েছে।
এসব দলের পক্ষ থেকেও সীমিত আকারে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে। তবে জাতীয় পার্টির এখন পর্যন্ত মাঠে তেমন কোনো সক্রিয়তা চোখে পড়েনি।
এ আসনে বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াত অনেক বেশি সক্রিয়। দল দুটি মাঠ গোছানোর পাশাপাশি হিন্দু ভোটারদের আকৃষ্ট করতে কার্যক্রম চালাচ্ছে। আসনে প্রায় দেড় লাখ হিন্দু ভোটার রয়েছেন। যারা অতীতে জয়-পরাজয় নির্ধারনণে বড় ভূমিকা রেখেছেন। আগামী নির্বাচনে এসব সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু ভোটার জামায়াতকে ভোট দেবে বলে মনে করছে দলটি।
কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, ২০২২ সালে এ আসনের বোদা উপজেলার মাড়েয়ার করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে স্মরণকালের নৌকাডুবির ট্রাজেডিতে ৭২ জন নিহত হন। এ ঘটনায় নিহত ও আহত পরিবারের পাশে দাঁড়ায় জামায়াত। নিহত পরিবারগুলোকে ২১ লাখ টাকা নগদ অর্থসহায়তা দেওয়া হয়। নিহত প্রত্যেকের পরিবার পায় ৩০ হাজার টাকা। নৌকাডুবিতে মা-বাবা হারানো শিশু দিপুর শিক্ষার দায়িত্বও নেয় জামায়াত।
এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজাসহ বিভিন্ন আয়োজনে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় জামায়াতের নেতা সফিউল্লাহ সুফিকেও। পূজা-পার্বণ ছাড়াও হিন্দুদের পারিবারিক বিভিন্ন আয়োজনেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এসব কারণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন জামায়াতের পক্ষেই থাকবে বলে আশা করছে দলটি।
সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখতে তৎপর রয়েছে বিএনপিও। করতোয়া নদীর নৌকাডুবির ট্রাজেডিতে প্রতি নিহত পরিবারকে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল বিএনপি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিরাপত্তা ও পূজা উদযাপন নিয়ে গভীর শঙ্কিত ছিলেন। সে সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় পল্লী বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে নিয়ে বোদা-দেবীগঞ্জের প্রায় ১২৫টি পূজা মণ্ডপ পরিদর্শন করেন এবং তাদের নিরাপত্তা প্রদানে আশ্বস্ত করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি প্রায় পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে ২৪ ঘণ্টা বিভিন্ন মন্দিরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে অন্যায় হামলা, মামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর বা কোনো প্রকার হয়রানি যাতে না ঘটে, সেজন্যও বিএনপি দায়িত্ব পালন করেছে। এসব কারণে আসনটিতে হিন্দু ভোটারদের বড় অংশ বিএনপির পক্ষে ভোট দেবেন বলে আশা করছেন আসনটির সম্ভাব্য প্রার্থী ফরহাদ হোসেন আজাদ।
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিপুল সংখ্যক ভোটারের সমর্থন পেতে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি দল বিএনপি ও জামায়াতই তৎপর। দু’দলের দলীয় কর্মসূচি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এবারের নির্বাচন এই দুই দলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
কেন্দ্রীয় বিএনপির পল্লী উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব হিসেবে নেতাকর্মীদের নিয়ে দল গোছানোর পাশাপাশি সংগঠনিকভাবে ব্যস্ত সময় পার করছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফার প্রচারপত্র মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করি, নিয়মিত সভা, সমাবেশ ও উঠোন বৈঠক করি। এর আগে আমি পঞ্চগড়-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নেই, কিন্তু রাতের ভোটে হেরে যাই। এরপরও বসে থাকিনি। পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলে যারা মাঠে থেকে দলীয় কর্মসূচি পালন করেছেন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্য থেকেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। দল যাকে মনোনয়ন দেবে, আমরা সবাই তার পক্ষেই কাজ করব।’
এনসিপির শিশির আসাদ বলেন, আমরা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের একটি অংশ। জনগণ আমাদের নতুন শক্তি হিসেবে দেখছে। আমরা সুসংগঠিতভাবে মাঠে নেমেছি। আশা করছি, জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে।’
জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য সফিউল্লাহ সুফি বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অনেক অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে টিকে রয়েছি। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে আমরা দল গোছানোর কাজ শুরু করেছি। এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় কাজ করছি। স্বাধীনভাবে সাংগঠনিক কাজ করতে পারছি। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ করছি। জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি এবং তারা আমাদের সাড়া দিচ্ছে। ইনশাআল্লাহ আমরা জয়ী হব। নির্বাচিত হওয়া বা সম্মান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ।
এই আসনে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে তিনটি শক্তিশালী দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে। একই সঙ্গে তরুণ ভোটারদের একটি বড় অংশ প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলের দিকে ধাবিত হতে পারে, এমনটাই ধারণা করছেন অনেক ভোটার।
এমবি/এআরএস