Logo

সারাদেশ

শীতলক্ষা ও বুড়িগঙ্গার পানি দূষণে উদ্বেগ

Icon

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:৩০

শীতলক্ষা ও বুড়িগঙ্গার পানি দূষণে উদ্বেগ

ছবি : বাংলাদেশের খবর

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দিন দিন বিষাক্ত হয়ে উঠছে। ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ কারখানার কাছে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) থাকলেও, খরচের কারণে তা নিয়মিত চালানো হয় না। এর ফলে নদীতে শিল্পবর্জ্য মিশছে, মাছ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, এবং নদী হয়ে উঠছে প্রাণহীন। শীতলক্ষার পানিতে হাত ডুবালে নদীকে চেনা মুশকিল, জল কালচে ও দুর্গন্ধযুক্ত।

ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের টেক্সটাইল, ডাইং, প্রিন্টিং, কেমিক্যাল ও লেদার প্রসেসিং কারখানাগুলি প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার বর্জ্য নদীতে সরাসরি ফেলে। বুড়িগঙ্গাও এই দূষণের শিকার হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজার টেক্সটাইল ও ডাইং কারখানা রয়েছে। তবে হাতে গোনা কয়েক ডজন কারখানায় ইটিপি স্থাপন থাকলেও, তা নিয়মিত চালু থাকে না।

কারখানার মালিকরা বলছেন, ইটিপি চালানো ব্যয়বহুল। প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার বর্জ্য পরিশোধন করতে গেলে বিদ্যুৎ, কেমিক্যাল, প্রযুক্তিবিদের বেতন—সব মিলিয়ে লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। তাই কাগজে-কলমে ইটিপি থাকলেও বাস্তবে তা অচল।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সেন্ট্রাল ইটিপি স্থাপনের প্রস্তাব দিচ্ছেন। এতে সব কারখানার তরল বর্জ্য নির্দিষ্ট পাইপলাইনের মাধ্যমে এক বা একাধিক কেন্দ্রীভূত পরিশোধনাগারে এসে প্রক্রিয়াজাত হবে।

২০১৪ সাল থেকে বিষয়টি আলোচনা হলেও আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সমীক্ষায় অন্তত তিনটি সেন্ট্রাল ইটিপি স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার সাথে প্রাথমিক আলোচনা হলেও কার্যক্রম শুরু হয়নি।

শীতলক্ষার দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। নদীর পানি ব্যবহার করা মানুষদের মধ্যে চর্মরোগ, পেটের অসুখ এবং কিডনি রোগ বেড়েছে। নারায়ণগঞ্জের চিকিৎসকরা বলছেন, শিল্পবর্জ্যে থাকা ভারী ধাতু—আর্সেনিক, সীসা, ক্রোমিয়াম—শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করে।

শীতলক্ষার সঙ্গে হাজার হাজার জেলের জীবনও জড়িত। এক সময় নদীতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। কুতুবপুর ইউনিয়নের জেলে খোকন দাস বলেন, ‘আমরা নদীতে জাল ফেলি, মাছ পাই না। পানি কালো, মাছ মরেও ভেসে আসে।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের জরিপে শীতলক্ষার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের অর্ধেকেরও কম।

কারখানার মালিকরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে খরচ কমাতে হবে। ইটিপি চালালে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, যা বিদেশি ক্রেতারা মেনে নেবে না। বিকেএমইএ’র এক কর্মকর্তা বলেন,‘ছোট ও মাঝারি কারখানা আলাদা ইটিপি চালাতে পারে না। সেন্ট্রাল ইটিপি দরকার। কিন্তু সরকার সহযোগিতা করছে না।’

পরিবেশবাদীরা এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের মতে, শিল্পকারখানার মুনাফার জন্য নদীকে নষ্ট করা অযৌক্তিক। পরিবেশ আদালতের আইনে শাস্তি থাকলেও, বাস্তবে কয়েকটি প্রতীকী জরিমানা ছাড়া কিছু হয় না। কারখানায় হঠাৎ অভিযান করলে মালিকরা কয়েক ঘণ্টা ইটিপি চালু করে, পরিদর্শক চলে গেলে বন্ধ। এভাবে বছরের পর বছর ‘চোর-পুলিশ খেলা’ চলছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ শূন্য থাকলেও সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী একাধিকবার কেন্দ্রীয় ইটিপি স্থাপনের দাবি তুলেছেন। তিনি বলেন, শহর রক্ষার জন্য শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করা জরুরি। তবে বাস্তবায়ন সরকারের উচ্চপর্যায় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্ব।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে বিদেশি ক্রেতারা এখন পরিবেশবান্ধব উৎপাদনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ছোট ও মাঝারি কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের সুনাম ঝুঁকির মুখে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিবেদনেও উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত টেকসই হতে হলে শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংস্কার দরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শিল্প মালিকদের খরচ ভাগাভাগির কার্যকর মডেল এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের সহযোগিতা ছাড়া শীতলক্ষা বাঁচানো সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহফুজা হক বলেন, ‘শিল্পায়ন থামানো যাবে না, কিন্তু টেকসই না হলে ধ্বংস ডেকে আনবে। সেন্ট্রাল ইটিপি ছাড়া শীতলক্ষা বাঁচানো সম্ভব নয়।’

প্রশ্ন হচ্ছে—শীতলক্ষার স্বচ্ছ জল, নৌকায় বৈঠার টান, মাছের ছলছল শব্দ কি আবার ফিরবে? অনেকেই মনে করেন, এখনও সময় আছে। কেন্দ্রীয় ইটিপি বাস্তবায়ন হলে দূষণ কমানো সম্ভব। ভারতের তিরুপ্পুরে সেন্ট্রাল ইটিপি কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশেও চাইলে সম্ভব, তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দৃঢ়তা এবং ব্যবসায়ীদের আন্তরিকতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। নারায়ণগঞ্জবাসীর দাবি—আলোচনা নয়, এবার বাস্তব পদক্ষেপ চাই।

এআরএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

জনদুর্ভোগ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর