ঠাকুরগাঁওয়ে কারাম পূজায় নৃত্য-গানে মুখরিত গ্রাম

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:০৬

ছবি : বাংলাদেশের খবর
রাত নেমে এসেছে, তবুও সারা গ্রাম আলোকোজ্জ্বল। ঢোল-মাদলের তালে ছন্দমান গানে মাতোয়ারা নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ—সবাই একসূত্রে গাঁথা। এভাবেই উদযাপিত হলো ওরাঁও নৃ-জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব কারাম পূজা।
বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাতে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের পাঁচপীর ডাঙ্গা গ্রামে অনুষ্ঠিত এই উৎসব। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার দিন এ আয়োজন চলে।
প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ওরাঁও সম্প্রদায় কারাম পূজার মাধ্যমে প্রকৃতি ও ফসলের দেবতা কারামের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী, এক সময় দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত হওয়া ওরাঁও জনগোষ্ঠী কারামের কৃপায় নতুন করে সমৃদ্ধি অর্জন করে। এই কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবেই শুরু হয় কারাম পূজা।
উৎসবের মূল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় কারাম গাছের ডাল। গান, নাচ ও নৈবেদ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে পূজা উদযাপিত হয়। সন্ধ্যা নামতেই তরুণরা ঢোল-মাদলের ছন্দে নৃত্য পরিবেশন করেন। মাথায় ফুল, হাতে তালপাতার পাখা, পায়ে ঝুমঝুমি ঘুঙুর ছন্দে সারা এলাকা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। আশপাশের গ্রাম থেকেও মানুষ ভিড় জমায়।
ওরাঁও নয়, সাঁওতাল, বাঙালি এবং অন্যান্য ধর্ম-বর্ণের মানুষও উৎসবে অংশ নেন।
উৎসবের প্রধান অতিথি, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘কারাম উৎসব কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক। এটি নৃ-জনগোষ্ঠীর শেকড়ের সঙ্গে প্রজন্মকে যুক্ত রাখে।’
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ইমরান হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আদিবাসী সংস্কৃতি বাংলাদেশের ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি বিশ্বনাথ কেরকেটা জানান, ‘ওরাঁও সম্প্রদায়ের জীবনের সবচেয়ে বড় আয়োজন কারাম পূজা। প্রতিবছর আমরা সবাই মিলে এক হয়ে এটি উদযাপন করি। এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব।’
একসময় কেবল ওরাঁও সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে কারাম পূজা সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষও এতে অংশগ্রহণ করেন। এটি মিলনমেলার মতো কাজ করে, যেখানে মিশে যায় ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের বার্তা।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের স্থানীয় নেতারা মনে করেন, সরকার ও সমাজের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া ঐতিহ্য রক্ষা কঠিন। তারা কারাম পূজাকে জাতীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
তবুও ওরাঁও সম্প্রদায় আশাবাদী। তাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও সমাজের সহযোগিতা থাকলে কারাম পূজা অক্ষুণ্ণ থাকবে। এই উৎসব কেবল একটি আচার নয়, বরং প্রকৃতি ও মানবতার মিলনমেলা যা শেখায় ঐক্য, সম্প্রীতি ও কৃতজ্ঞতার পাঠ।
আবু সালেহ/এআরএস