বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন ভিসা জটিলতায় নেই পর্যটক পারাপার

এসকে দোয়েল, পঞ্চগড়
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:০২
-(7)-68ccfff597a48.jpg)
গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে দেশের স্থলবন্দরগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চতুর্দেশীয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। বন্দরটিতে পর্যটন, চিকিৎসা ও শিক্ষাক্ষেত্রেও দেশের এ ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ভারত ইমিগ্রেশনটিতে ভিসা জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীপারাপার কমে যাওয়ায় স্থবিরতা বিরাজ করছে।
ইমিগ্রেশন ঘুরে দেখা যায়, যাত্রী পারাপারের অভাবে ইমিগ্রেশনটিতে অলস সময় কাটছে ইমিগ্রেশন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। দিনে গড়ে ৪০-৭০ জন যাত্রী পারাপার হচ্ছে এ রুট দিয়ে। ভারত ট্যুরিস্ট ভিসা দেয়া বন্ধ রাখায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে যাত্রী পারাপার। গুরুত্বপূর্ণ এ রুট ব্যবহার করে সহজ ও কম খরচে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার সুবিধা থাকলেও সব স্থবির ভিসা জটিলতায়।
ইমিগ্রেশনের তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এ রুট ব্যবহার করে ২০ হাজার ৯৫৮ জনের আগমন ঘটেছে। পার হয়েছেন ২০ হাজার ১২৫ জন যাত্রী। জুলাই অভ্যুত্থানে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ইমিগ্রেশন রুট দিয়ে ২২ হাজার ৪৯১ জন যাত্রী পারাপার হয়েছেন। এর আগের বছর ২০২৩ সালে ইমিগ্রেশনটিতে যাত্রীপারাপার হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৪২ জন। এরমধ্যে ৩১ হাজার ৬১২ জন যাত্রী ভারতে যান।
কারণ হিসেবে জানা গেছে, জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থানে সরকার পতনে বাংলাদেশ-ভারতের বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। তখন থেকে বাংলাদেশিদের ট্যুরিস্ট ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে ভারত। শুধুমাত্র যাদের বিজনেস, মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসা রয়েছে এরকম ভিসাধারীদের এ রুট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। মূলত ভিসা জটিলতাই যাত্রী পারাপারে ভাটা পড়ায় স্থবিরতা বিরাজ করছে ইমিগ্রেশনটিতে।
২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী (ভারত) স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন সুবিধা চালু করা হয়। ইমিগ্রেশন চেকপোস্টটির ভিসা চালুর সময় থেকেই প্রতিদিন ৫০০- ৬০০ মানুষ যাতায়াত করতেন। মহামারি করোনাকাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বন্ধ ছিল ট্যুরিস্ট ভিসা। এতেও কমে যায় যাত্রী পারাপার। বর্তমানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ থাকায় বিজনেস, স্টুডেন্ট ও মেডিকেল ভিসায় দিনে ৪০ থেকে ৭০ জন পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত করছেন। এ পর্যটকের অভাবে কমে গেছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দোকানপাটের ব্যবসা। এতে সরকারও হারাচ্ছে রাজস্ব।
বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে একাধারে চার দেশের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইমিগ্রেশন চালুর পর রংপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে ভিসা সেন্টার চালু করে ভারতীয় হাইকমিশন। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন পার হলেই ওপারে ভারতের পশ্চিবঙ্গের অন্যতম বড় শহর শিলিগুড়ি। আর শিলিগুড়ি হয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যাতায়াত সুবিধার জন্য অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। এ রুট ব্যবহার করে ভারতের শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিকিম, গ্যাংটক, ডুয়ার্স, কলকাতাসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় বিনোদনের উপভোগের পাশাপাশি চিকিৎসা নিতে পারেন পর্যটকরা।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যতগুলো স্থলবন্দর চালু রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক স্থলবন্দর এই চারদেশীয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাবান্ধা ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর, শিলিগুড়ি, জলপাইগুঁড়ি জেলার ভেতরেই অবস্থান। এ অ্ঞ্চলের চারপাশে রয়েছে ভারতের স্থানীয় বিধান-নগর, চাত্তের হাট, ঘোষপুর, রাহমু, ফুলবাড়ি ও আমবাড়িয়া। এখান থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ৭০ কিলোমিটার, শিলিগুড়ি ১০ কিলোমিটার, নেপাল সীমান্ত ৫৪ কিলোমিটার, ভুটান ৬৮ কিলোমিটার ও চীন সীমান্ত মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে।
যোগাযোগের ব্যবস্থার দিক থেকে বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাঁকরভিটা ট্রানজিট পয়েন্টের দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হতে জেলা শহরের দূরত্ব মাত্র ৫৪ কিলোমিটার এবং রাজধানী ঢাকা ৪৯৫ কিলোমিটার। রেলপথে ফুলবাড়ি স্থলবন্দর ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আকাশপথে ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক করিডোর হচ্ছে দার্জিলিং জেলার বাগডোগরা বিমানবন্দর। যা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে বিমান বন্দরের দূরত্ব মাত্র ১৬ কিলোমিটার। বাংলাবান্ধা থেকে সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট-এর দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। সড়ক, রেল ও আকাশ পথেও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চতুদের্শীয় স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশনটি।
স্থানীয়রা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলের এপার-ওপার দুই বাংলায় রয়েছে মানুষের প্রচুর আত্মীয়-স্বজন। এ জেলার উত্তরে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা, উত্তরপূর্ব ও পূর্বে জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পূর্ণিয়া ও উত্তর দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। ভিসার মাধ্যমে মানুষ সহজেই যাওয়া-আসার মাধ্যমে দেখে আসতে পারেন স্বজনদের। কিন্তু ভ্রমণ ভিসা বন্ধ থাকায় এসব মানুষরা না যেতে পারছেন ভারতে, না আসতে পারছেন বাংলাদেশে।
বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, বছরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি এ ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ব্যবহার করে ভারতে গিয়ে থাকেন। ট্যুরিস্ট ভিসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ ইমিগ্রেশন। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের অসংখ্য রোগী, শিক্ষার্থীসহ পর্যটকরা ভারতে গিয়ে শিলিগুড়ি, দার্জিলিং ও মিনি বাংলাদেশে ঘুরে ফিরে কেনাকাটা করে থাকেন। এমনকি বিয়ের কেনাকাটাও করেন। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ভারত-বাংলাদেশের বৈরী সম্পর্কের কারণে ইমিগ্রেশন চালু থাকলেও ভারতীয় ট্যুরিস্ট ভিসা না থাকায় এ রুটটি ব্যবহার করতে পারছেন না পর্যটকরা। যতক্ষণ না দেশে নির্বাচিত সরকার না আসছে, সে পর্যন্ত এমন অবস্থা থাকতে পারে বলে মনেন করছেন তারা।
তেঁতুলিয়া ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম, অ্যাপল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসহ বেশ কয়েকটি পর্যটক সেবা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ করে দেওয়ায় ইমিগ্রেশনটিতে যাত্রীপারাপার কমে গেছে। যাত্রী সংকটে ইমিগ্রেশনে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। আরেকদিকে ভারত ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ রাখায় তাদের পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে। কারণ ভারতের বিভিন্ন পর্যটন স্পট ও চিকিৎসা সেবা নিতে বিপুল পরিমাণের বাংলাদেশি পর্যটক এ রুট ব্যবহার করে থাকে। এখন পর্যটক ভিসা বন্ধ থাকায় পর্যটকের সংকটে সেখানকার পর্যটননির্ভর হোটেল-মোটেল এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। পাশাপাশি ইমিগ্রেশনটি কর্মচাঞ্চল্য হারিয়েছে। তবে বন্দর সংশ্লিষ্ট, ব্যবসায়ীরা মনে করছেন দেশে নির্বাচিত সরকার গঠিত হলে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি হলে আগের মতো ইমিগ্রেশনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরবে বলে আশা করছেন।
এ বিষয়ে বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কেফায়েতুল ওয়ারেছ জানান, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের এ ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় চেকপোস্ট দিয়ে চার দেশের মানুষ যাতায়াত করেন। বর্তমানে এ চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন ৪০-৭০ জন যাত্রী পারাপার হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, গত ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এ রুট ব্যবহার করে ২০ হাজার ৯৫৮ জনের আগমন ঘটেছে। পার হয়েছেন ২০ হাজার ১২৫ জন যাত্রী। ট্যুরিস্ট ভিসার অনুমতি না থাকায় বর্তমানে ব্যবসা, স্টুডেন্ট ও মেডিকেল ভিসাধারীরা এ রুট ব্যবহার করে যাওয়া করছেন।
- এমআই