পুলিশ বলছে দুর্ঘটনা, পরিবারের দাবি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড

নাটোর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:৩৪
---2025-10-01T173439-68dd11e03b74e.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
সিরাজগঞ্জে গাড়ি চাপায় দুইজনের মৃত্যু প্রথমে হাইওয়ে পুলিশ ‘দুর্ঘটনা’ বলে জানিয়েছে। তবে নিহতদের পরিবার দাবি করছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও তাড়াশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোনায়েম হোসেন জেমস সাদা রঙের হাইয়েস গাড়ি দিয়ে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ২০২৫ সালের ২৪ মার্চ সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার হরিণচুড়া এলাকায় মোটরসাইকেলযোগে আদালতে যাওয়ার পথে নিহত হন তাড়াশের হিমনগর গ্রামের মৃত আব্দুল আজীজ ফারুকীর ছেলে রোকনুজ্জামান ওরফে রোকন ফারুকী (৩০) এবং মৃত শফিকুল ইসলামের ছেলে নাসির উদ্দিন নান্টু (৩৮)। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে একদিনের ব্যবধানে দু’জনই মারা যান।
নিহত রোকনের ভাই ফেরদৌস মামুন অভিযোগ করেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুল বুঝিয়ে তার কাছ থেকে সাক্ষর নেন এবং মরদেহের ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন সম্পন্ন করা হয়। পরে নিহত রোকনের মা রোকেয়া বেগম ১৫ এপ্রিল গুরুদাসপুর আমলী আদালতে হত্যা মামলা করেন। এতে মোনায়েম হোসেন জেমস, তার ছোট ভাই জাকির হোসেন, বাবা আব্দুল ওয়াহাবসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
গুরুদাসপুর থানার উপপরিদর্শক মো. মাসুদ রানা আদালতে প্রতিবেদন দিলেও তাতে হত্যার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ না থাকায় বাদি পুনরায় মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নাটোরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, জমি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধের জের ধরে পরিকল্পিতভাবে হত্যার ছক কষা হয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও মোবাইল কল সিডিআরেও অভিযুক্তদের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হলেও পুলিশ শুরুতে দায়সারা তদন্ত করেছে।
নিহত রোকনের মা রোকেয়া বেগম অভিযোগ করেন, যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তরা প্রভাবশালী ও বিত্তশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা ন্যায়বিচার চাই।
গুরুদাসপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মাসুদ রানা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৪ মার্চ সকালে পূর্বনির্ধারিত মামলার তারিখে নিহত রোকনুজ্জামান ফারুকী ও নাসির উদ্দিন নান্টু মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি থেকে বের হন।
সকাল ৮টা ১১ মিনিটে তারা তাড়াশ উপজেলার মান্নাননগর বাজারের সমবায় মোটর শ্রমিক ফিলিং স্টেশনে তেল নেন। ঘটনাটি ফিলিং স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে। এর আগে সকাল ৭টা ৪৪ মিনিটে দুটি সাদা রঙের গাড়ি ওই ফিলিং স্টেশনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। একজন মোবাইলে কথা বলছেন এবং অন্যজন গাড়িতে উঠছেন। কিছুক্ষণ পর তারা নাটোরের দিকে চলে যান।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ৮টা ১১ মিনিটে দুইজন ফিলিং স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করলে হরিণচুড়া এলাকায় একটি হাইয়েস গাড়ি মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয়। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে রোকন ফারুকীকে মৃত ঘোষণা করা হয়। নাসির উদ্দিন একদিন পর মারা যান।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা সাগর হোসেন জানান, দুর্ঘটনার সময় আশপাশে অন্য কোনো যানবাহন ছিল না। “মোটরসাইকেলটি ধীরগতিতে চলছিল না; হাইয়েস গাড়িটি ইচ্ছাকৃতভাবে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে।
তদন্তে বাদি কর্তৃক প্রদত্ত অভিযুক্তদের ৭টি মোবাইল নম্বর পর্যালোচনা করা হয়। সবগুলো নম্বরই তাদের নামে নিবন্ধিত। কল সিডিআর বিশ্লেষণে আরও ৪টি নম্বর শনাক্ত হয়েছে, যা অভিযুক্ত ও তাদের স্বজনদের নামে। ২৪ মার্চ ভোর ৪টা থেকে সকাল ৯টার মধ্যে এই ৮টি নম্বর হত্যাকাণ্ডের স্থান ও আশপাশে অবস্থান করেছিল।
নিহত রোকনের ভাই শাওন ফারুকী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা মোনায়েম হোসেন জেমস সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম। বহু অপরাধে তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশিত হলেও হত্যাকাণ্ডের পরও তিনি পলাতক।’
সিরাজগঞ্জ হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ঘটনাস্থলের সাদা হাইয়েস গাড়ি শনাক্ত করা যায়নি। তদন্তে হত্যাকাণ্ডের মতো কোনো সুনির্দিষ্ট আলামত পাওয়া যায়নি। তাই বিষয়টি সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।’
সিআইডির পরিদর্শক মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে নথি পাওয়ার পর তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই সঠিক প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তদন্ত শেষে জানা যাবে এটি প্রকৃতপক্ষে হত্যাকাণ্ড নাকি দুর্ঘটনা।’
- নাজমুল হাসান/এমআই