নেই প্লাটিলেট মেশিন, নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গুর ভয়াবহ রূপ

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:৫৭
-(73)-68dfd63b814af.jpg)
ছবি : সংগৃহীত
প্লাটিলেট কমে গেলে ঢাকায় যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। রোজিনা আক্তার শহরের পশ্চিম দেওভোগ বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা। ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় পৌঁছেছিলেন তিনি। তার প্লাটিলেট দ্রুত কমছিল-৬৫ হাজার থেকে নেমে আসে ১৮ হাজারে। পরিবারের লোকজন অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকার ডিএনসিসি ডেঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিন দিনের মধ্যেই অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
হাসপাতালের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভিক্টোরিয়া ও খানপুর হাসপাতালে কোনো সিট নেই। রোগীর প্লাটিলেট সামান্য কমলেই ডাক্তাররা বিরক্ত হয়ে পড়েন এবং ঢাকায় রেফার করার কথা বলেন। অথচ ঢাকায় গিয়ে স্যালাইন ও ইনজেকশনেই প্লাটিলেট কমে যাওয়া রোগীরা দুই-তিন দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে ওঠেন। নারায়ণগঞ্জে ডাক্তাররা তাকে বলেছিলেন মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়েছে। সেই কথা শুনে রোজিনা আক্তার আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিলেন।’
কিন্তু ঢাকায় গিয়ে দেখা গেল, তার শরীরে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। উন্নত স্যালাইন ও ইনজেকশনে ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৮ হাজার থেকে তার প্লাটিলেট বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৩৪ হাজারে। এখন তিনি বাড়িতে রয়েছেন, দুর্বলতা কাটাতে খাবার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়। এটি মহামারির সীমা অতিক্রম করে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) এলাকায় প্রতিদিন নতুন রোগী বাড়ছে। ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল, খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতাল কিংবা শহরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে রোগীর ভিড় সামলানো যাচ্ছে না। চিকিৎসকরা বলছেন, জেলাজুড়ে এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ডেঙ্গুর প্রকোপ নেই। প্রতিদিন শত শত রোগীকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে। কারণ একটাই-নারায়ণগঞ্জে একটি প্লাটিলেট মেশিনও নেই। ফলে রক্তের প্রয়োজন হলে দ্রুত পরীক্ষা করা যায় না। প্লাটিলেট হঠাৎ কমে গেলে ডাক্তাররা ঢাকায় পাঠানো ছাড়া উপায় দেখেন না।
রোজিনা আক্তারের অভিজ্ঞতা নারায়ণগঞ্জের বহু রোগীর বাস্তব চিত্র। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে একই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। জেলায় কোনো হাসপাতালে প্লাটিলেট কাউন্ট মেশিন না থাকায় সামান্য সন্দেহ হলেই রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হয়।
ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা চাই না কোনো রোগী মারা যাক। কিন্তু প্লাটিলেট যদি ২০ হাজারের নিচে নেমে যায়, জরুরি পরীক্ষা দরকার হয়। এখানে সেই সুযোগ নেই। ঢাকায় পাঠানো ছাড়া আমাদের কোনো পথ থাকে না। অথচ ঢাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ রোগীর রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। উন্নত চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণেই তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন।’
সদর উপজেলার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন তার ৯ বছরের ছেলেকে নিয়ে গত সপ্তাহে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে যান। ছেলের প্লাটিলেট দ্রুত কমছিল। কর্তব্যরত ডাক্তার সরাসরি জানালেন-‘ঢাকায় নিয়ে যান, এখানে আমরা কিছু করতে পারব না।’ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ আলাদা। আমরা সাধারণ মানুষ, হঠাৎ এত টাকা কোথায় পাব?’ এভাবে প্রতিদিন অসংখ্য পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকলেই বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। করিডোরে বিছানা পেতে শুয়ে আছেন রোগীরা। কেউ মেঝেতে, কেউ বারান্দায় মশারি টানিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নার্সরা স্বীকার করছেন, রোগীর চাপ সামলানো যাচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতালেও একই অবস্থা, তবে খরচ অনেক বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ সেখানে যেতে পারেন না।
জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে একটিও প্লাটিলেট সেপারেটর মেশিন নেই। অথচ এ মেশিন ছাড়া আধুনিক চিকিৎসা সম্ভব নয়।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো হঠাৎ প্লাটিলেট কমে যাওয়া। তখন দ্রুত পরীক্ষা দরকার হয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে মেশিন নেই। ফলে অনেক সময় রোগীকে অকারণে ঢাকায় পাঠাতে হয়। এতে রোগীর খরচ ও ঝুঁকি দুটোই বাড়ে।’
সরকারি হিসাবে এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে ১০ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৯৭ জন। তবে স্থানীয় সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের দাবি, আসল সংখ্যা এর দ্বিগুণ। প্রতিদিন ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন ৫০-১০০ জন নতুন রোগী। শিল্পনগরী হয়েও নারায়ণগঞ্জে স্বাস্থ্যখাতে কোনো বড় বিনিয়োগ হয়নি। জেলা সদর হাসপাতাল এখনও ২০০ শয্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আধুনিক ডায়াগনস্টিক সুবিধা নেই।
বন্দর এলাকার বাসিন্দা হাসানুজ্জামান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জকে দেশের শিল্পের হৃৎপিণ্ড বলা হয়। কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আসে এখান থেকে। কিন্তু একটা প্লাটিলেট মেশিনও কেনা হলো না! এ দায় কার?’
ডা. লুৎফর রহমান মনে করেন, এটি মূলত নীতিগত ব্যর্থতা। জেলায় অন্তত তিনটি বড় হাসপাতালে প্লাটিলেট মেশিন থাকা উচিত ছিল। এখন রোগীরা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। শুধু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মানুষকে আরও অসহায় করে তুলছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। তবে মেশিন আনার সময়সীমা এখনও জানা যায়নি।
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি সত্যিই ভয়াবহ। আমরা প্রতিদিন রিপোর্ট দিচ্ছি। তবে মেশিনের ব্যবস্থা করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়।’
নাসিকের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, তারা মশা নিধনে কাজ করছেন। তবে সমালোচকরা বলছেন, মূল সংকট চিকিৎসা ব্যবস্থায়। মশা মারার পাশাপাশি হাসপাতালের সক্ষমতা না বাড়ালে সমস্যার সমাধান হবে না।
এখন শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সামাজিক সংগঠন-সবাই প্লাটিলেট মেশিনের দাবিতে সোচ্চার। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিদিনই স্লোগান উঠছে-নারায়ণগঞ্জে অন্তত দুটি প্লাটিলেট মেশিন চাই। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে যেসব সুবিধা আছে, তার ছিটেফোঁটাও নারায়ণগঞ্জে নেই। অথচ প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় ছুটছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, অক্টোবর-নভেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকবে। দ্রুত প্লাটিলেট মেশিন আনা না হলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে।
- ইমতিয়াজ আহমেদ/এমআই