ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির মিলনমেলা বীরগঞ্জে

বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫৫
-68e09aba44f91.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ শুক্রবার বিকেলের পর থেকে রঙে ও আলোয় মুখরিত হয়ে ওঠে।
দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা হাজারো মানুষের পদচারণায় ভরে ওঠে চারপাশ। কাঁচের চুড়ির টুংটাং শব্দ, ঢাক-ঢোলের বাজনা এবং মাইক থেকে ভেসে আসা আদিবাসী গানের সুরে সারা মাঠ আনন্দময় হয়ে ওঠে। এই উৎসবটি দুই শত বছরেরও পুরনো এবং ‘বাসিয়া হাটি মেলা’ নামে পরিচিত।
প্রতিবছর দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরদিন মেলা বসে। দূর-দূরান্ত থেকে সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এখানে ভিড় জমান। শুধু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নয়, হিন্দু-মুসলিমসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষও অংশ নেন মিলনমেলায়। রঙিন শাড়ি, মাথায় ফুল, হাতে কাঁচের চুড়ি আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিকে তরুণীরা যেন রঙের উৎসবে মেতে ওঠেন।
মেলার মাঠে দোকানিদের পসরা, চুড়ি, ফিতা, ঝিনুক, মাটির পাত্র, দা-কুড়াল থেকে শুরু করে হাঁড়ি-পাতিল—সবই একসাথে দেখা যায়। মেলা কেবল কেনাকাটার স্থান নয়; এটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সামাজিক উৎসব এবং পারিবারিক মিলনমেলা। দিনভর চলে নাচ-গান, দলগত পরিবেশনা এবং তরুণ-তরুণীদের প্রাণখোলা আড্ডা। এত মানুষের ভিড়ে অনেক সময় মোবাইল নেটওয়ার্কও কাজ করতে হিমশিম খায়।
শতবর্ষ ধরে এই মেলাকে ঘিরে একটি বিশেষ রীতি গড়ে উঠেছিল—যুবক-যুবতীরা এখানে জীবনসঙ্গী বেছে নিতেন। পছন্দ হলে পরিবারগুলোর আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তীতে বিয়ের আয়োজন হতো। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন সেই প্রচলন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
আদিবাসী তরুণী এঞ্জিলিনা মার্ডি বলেন, ‘শুনেছি এক সময় এই মেলায় জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার রীতি ছিল। তবে এখন আর আগের মতো নেই। সময় বদলেছে, সেই সাথে বদলেছে আমাদের জীবনযাত্রাও।’
আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির আহ্বায়ক জোসেফ হেমরম জানান, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা এ মেলা শুরু করেছিলেন। আমরা কেবল তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করছি। কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়, তবে আনুমানিক কয়েক শত বছর ধরে চলছে। বিয়ের রীতি আগের মতো নেই, তবে মেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ সহযোগিতা করে।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য আলহাজ্ব মনজুরুল ইসলাম মনজু বলেন, ‘এই মেলা আমাদের দীর্ঘ দিনের সম্প্রীতির নিদর্শন। এখানে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ একসাথে মিলিত হয়। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, আমাদের সংস্কৃতি ও ভালোবাসার বন্ধনের প্রতীক।’
দুই শত বছরের পুরনো ‘বাসিয়া হাটি মেলা’ আজও মানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে আছে। এটি শুধু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং সবার জন্যই আনন্দের উৎসব, যেখানে মিলেমিশে যায় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সম্প্রীতির অমূল্য বন্ধন।
প্রদীপ রায় জিতু/এআরএস