মানিকগঞ্জ-২ : বিএনপি-জামায়াতের লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি
আফ্রিদি আহাম্মেদ, মানিকগঞ্জ
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:২৪
গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরব হয়ে উঠেছে মানিকগঞ্জ-২ আসন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এখন মাঠে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। দুই দলের প্রার্থীরাই তৃণমূলে জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন, দিচ্ছেন উন্নয়ন আর পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি।
মানিকগঞ্জ জেলার তিনটি আসনের মধ্যে মানিকগঞ্জ-২ সবচেয়ে আলোচিত। পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত এই এলাকা নদীভাঙন, চরাঞ্চলের জীবনসংগ্রাম, কৃষিজ উৎপাদন ও যোগাযোগ সমস্যার কারণে সব সময় আলোচনায় থাকে। একই সঙ্গে এই আসনের গর্ব-ইলিশ মাছ, গাজর, ফুলকপি ও নানা সবজি উৎপাদন।
মানিকগঞ্জ-২ আসনের মাঝে আছে অনেক গুণী ব্যক্তির নাম। শামসুল ইসলাম খান যিনি শিল্প মন্ত্রী ছিলেন, মুন্নু গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির প্রয়াত চেয়ারম্যান ও বিএনপি'র সময় কালের মন্ত্রী হারুনুর রশিদ খান মুন্নু, ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলী, বাউল শিল্পী হিসেবে পরিচিত রশিদ সরকারসহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এই আসনের বিভিন্ন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন।
এই আসনে রাজনীতির ইতিহাস দীর্ঘ। আশির দশকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম সারওয়ার মিলন টানা দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপির শামসুল ইসলাম খান টানা দুই মেয়াদে জয়ী হন। তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে এমপি হন বিএনপির তরুণ নেতা মইনুল ইসলাম খান শান্ত।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় পান জাতীয় পার্টির এস. এম. আব্দুল মান্নান। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০১৮ সালে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু মমতাজকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বর্তমানে আসনটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৩, নারী ভোটার ২ লাখ ৩২ হাজার ১১৩ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৩ জন।
মানিকগঞ্জ-২ আসনটি গঠিত হয়েছে সিংগাইর, হরিরামপুর ও মানিকগঞ্জ সদরের ভাড়ারিয়া ও হাটিপাড়া ইউনিয়ন নিয়ে। ঢাকার উপকণ্ঠে হওয়ায় রাজনৈতিক গুরুত্বও বেশি।
সরেজমিনে ভোটারদের কাছে বাংলাদেশের খবর, প্রথমেই সবুজ মিয়ার কাছে। তার কাছ থেকে জানবো বিগত সময়ে এই এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের উন্নয়নের ছোঁয়া কেমন ছিল?
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ভাড়ারিয়া ইউনিয়নের সানবান্ধা গ্রামের বাসিন্দা সবুজ মিয়া বলেন, ‘প্রকৃতভাবে যারা অসহায় তারা সরকারি সহযোগিতা পায়নি, যিনি গরিবের টাকা মারবে না, এমন সংসদ সদস্য চাই।’
একই এলাকার ব্যবসায়ী সিরাজ বলেন, ‘ভেতরের রাস্তাঘাট তেমন কিছুই হয় নাই। নাম মাত্র কিছু কাজ করতো যা উন্নয়নের থেকে মানুষের ক্ষতি বেশি হত। আমরা এখন এমন একজনকে চাই, যে আমাদের দোরগোড়ায় এসে আমাদের কষ্টের কথা শুনবে।’
হরিরামপুর চালা ইউনিয়নের জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমাগো এলাকায় আগে মাটির ব্যাবসা হইত, যা চেয়ারম্যানও নিজেই করত। আবার এখনকার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। মাটির ব্যাবসার কারণে রাস্তাঘাটের অবস্থা বেজায় খারাপ হয়ে যায়। এসব অবৈধ মাটির ব্যাবসা যে থামাইতে পারব আমরা তারে ভোট দিমু।’
ধুলসুরা ইউনিয়নের সোলায়মান বলেন, ‘জামায়াত-বিএনপি সবাই ভালোই প্রচার-প্রচারণা চালাইতেছে। যে আমাদের খোঁজ খবর বেশি রাখব, তারে আমরা ভোট দিমু।’
সিংগাইরের জামিত্তা ইউনিয়নের মানিক বলেন, ‘আমরা চাই যেই আসুক মারামারি হানাহানি যেন বন্ধ করে। জামায়াতের লোকজনও আহে, আবার বিএনপির লোকজনও আহে তারা সবাই খুব ভালো ভালো কথা কয়।’
এখন এই আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। তাদের মধ্যে সিংগাইর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবিদুর রহমান খান রোমান ও সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মইনুল ইসলাম খান শান্ত আলোচনায় আছেন।
সিংগাইর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবিদুর রহমান খান রোমান বলেন, ‘তারেক রহমানের ৩১ দফা জনগণের কাছে তুলে ধরছি। ৩১ দফার মধ্যে ১৯ দফা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দিয়ে গিয়েছিলেন। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তারেক রহমান ৩১ দফা ঘোষণা দিয়েছে যা সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। বিগত সময়ের এমপিরা যেসব কাজ করতে পারেনি সেসব অসমাপ্ত কাজগুলো আমি সম্পন্ন করব। চরাঞ্চলে এখনো যাওয়া হয়নি, সেখানে গিয়ে দেখে তারপরে তাদের নিয়ে কাজ করব।’
সাবেক এমপি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মঈনুল ইসলাম খান শান্ত ৩১ দফা নিয়ে প্রত্যেকটি ইউনিয়নে গিয়ে সভা সমাবেশ ও জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা রাখছে। তিনি বলেন, হরিরামপুরের মূল সমস্যা নদীভাঙ্গন। এই নদীভাঙ্গন রোধ করতে স্থায়ী বাধ নির্মাণ করতে হবে। এছাড়াও অবকাঠামো অনেক উন্নয়ন করতে হবে যা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারলে করতে পারব। প্রতিনিয়তই চরাঞ্চলের মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা শুনছি, জনগণ মনোনীত করতে পারলে অবশ্যই চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য ভালো কিছু করব।
হেমায়েতপুর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক চাইলেই চার-লেন করা সম্ভব এবং জনগণের এই দাবি যৌক্তিক। রাস্তার দুই পাশে যে জায়গাগুলো আছে তা প্রায় পরিত্যক্ত যেমন খাল রয়েছে তা ব্যবহার হয় না, কাজেই চার লেনে উন্নীত করলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও দৃঢ় হবে।’
পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের মনোনীত প্রার্থীও। বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ জাহিদুর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে। মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ ভোটারদের কাছে প্রতিনিয়ত ছুটে যাচ্ছেন তিনি।
মুহাম্মদ জাহিদুর রহমান বলেন, ‘মানিকগঞ্জ-২ আসনের যতটুকু এরিয়া সবটুকুই আমার চোখের মনি, আমি কোনোটা বাদ দিতে পারব না। সবটাই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজেই সব জায়গায় সমস্যা সমাধানে এবং উন্নয়নে আমি কাজ করবো। চরাঞ্চলের মানুষের কাছে আমি গিয়েছিলাম তাদের সাথে কথা বলেছি, আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে চরাঞ্চলের মানুষের সব থেকে বড় দুঃখ কষ্টের জায়গা সেটা হলো পদ্মার ভাঙন। আমি নির্বাচিত হতে পারলে এই পদ্মার ভাঙন রোধে কাজ করব এবং সরকারি যত বাজেট আছে তা এই পদ্মা ভাঙনে ব্যয় করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হেমায়েতপুর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক এটা ঢাকা আরিচা মহাসড়ক হবার কথা ছিলো, যেটা ধামরাই দিয়ে গেছে। পরবর্তীতে দুর্ভাগ্যবশত এটা আর হয় নাই। তবে এটি চারলেন করা খুবই জনগুরুত্বপূর্ণ একটি দাবি যা এলাকার সব মানুষ আমাদের সহযোগিতা করবে। আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে যত দ্রুত সম্ভব এটাকে চার লেনে রূপান্তর করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও এমপি পদপ্রার্থী মুহাদ্দিস শেখ মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘চরাঞ্চল নিয়ে আমি বিশেষভাবে কাজ করব, চরাঞ্চলেল মূল সমস্যা অবৈধ বালু উত্তোলন করা হয়, যার কারণে নদীভাঙ্গন হচ্ছে। পদ্মার এপার ওপার দুই পারেই স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করব। চরাঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও কৃষি এগুলো উন্নয়নের জন্য আমরা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করব যাতে চরাঞ্চল অবহেলিত না থাকে। এছাড়াও আমি মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব।’
এছাড়াও খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও গণ অধিকার পরিষদও আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করেছে। এসব দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন- খেলাফত মজলিসের মুহাদ্দিস শেখ মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, হেফাজতে ইসলামের খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, জমিয়তের মুফতি শামসুল আরেফিন খান সাদী এবং গণ অধিকার পরিষদের মো. মুসা মিয়া।
- এমআই

