Logo

সারাদেশ

নারায়ণগঞ্জে ১০ মাসে ৪৮৯ অগ্নিদুর্ঘটনা

Icon

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:১৬

নারায়ণগঞ্জে ১০ মাসে ৪৮৯ অগ্নিদুর্ঘটনা

ছবি : এআই দিয়ে তৈরি।

শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে অগ্নিদূর্ঘটনা বেড়েই চলছে। প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ। নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১০ মাসে নারায়ণগঞ্জ জেলায় মোট অগ্নিকান্ড ঘটেছে ৪৮৯টি। 

এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকার সম্পদ। এ সকল দূর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় উদ্ধার হয়েছে ৩০৪ কোটি টাকার সম্পদ। নিহত হয়েছেন ১৭ জন।

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জানান, শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক ভবন, সুপারমার্কেট ও বহুতল আবাসিক ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নেই। কোন পক্ষই অগ্নিনিরাপত্তা আইন মানছে না। ফলে প্রতিবছর অগ্নিদূর্ঘটনায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ মহানগরের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত কেমিক্যাল গোডাউনে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত চলছে, কারণ এসব গোডাউনে অগ্নিনিরাপত্তা নেই।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ মহানগরের নয়ামাটি হোসিয়ারী এলাকা, টানবাজার, নিতাইগঞ্জ ও উকিলপাড়া এলাকায় অবস্থিত কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিনিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বছরের পর বছর ধরে ব্যবসা করে আসছে। জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞাকেও তারা উপেক্ষা করছে। ফলে প্রতিবছর নয়ামাটি হোসিয়ারী এলাকা, টানবাজার, কালিরবাজার ও নিতাইগঞ্জ এলাকায় অগ্নিদূর্ঘটনা ঘটে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে জানুয়ারিতে অগ্নিদূর্ঘটনা ঘটেছে ৮৯টি। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার। সম্পদ উদ্ধার হয়েছে ২৬৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার। ফেব্রুয়ারিতে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। মার্চে অগ্নিদূর্ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৫৫ লাখ টাকা, সম্পদ উদ্ধার হয়েছে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এপ্রিল মাসে ৭৬টি অগ্নিদূর্ঘটনা ঘটেছে, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ২ লাখ টাকা, সম্পদ উদ্ধার হয়েছে ১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

মে মাসে ৬২টি অগ্নিদূর্ঘটনা ঘটেছে, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৬৬ লাখ টাকা, সম্পদ উদ্ধার হয়েছে ৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। জুনে ৫০টি অগ্নিদূর্ঘটনা, ক্ষয়ক্ষতি ১ কোটি ২ লাখ টাকা, সম্পদ উদ্ধার ৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। জুলাইয়ে ৩৮টি অগ্নিদূর্ঘটনা, ক্ষয়ক্ষতি ৪৬ লাখ টাকা, সম্পদ উদ্ধার ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

আগস্টে ৪২টি অগ্নিদূর্ঘটনা, ক্ষয়ক্ষতি ২৫ লাখ টাকা, সম্পদ উদ্ধার ৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে ৫০টি অগ্নিদূর্ঘটনা, ক্ষয়ক্ষতি ৭৮ লাখ টাকা, সম্পদ উদ্ধার ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ২৫টি অগ্নিদূর্ঘটনা ঘটেছে, ক্ষয়ক্ষতি ৩৪ লাখ টাকা, সম্পদ উদ্ধার ১ কোটি টাকা।

নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, শিমরাইল ও গলাচিপা এলাকায় হাজার হাজার গার্মেন্টস, ডাইং ও প্লাস্টিক কারখানা ছড়িয়ে রয়েছে। এর অনেকগুলোই অবৈধ বা অননুমোদিত ভবনে গড়ে উঠেছে। অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম থাকলেও সেগুলোর বেশির ভাগই অকেজো বা কেবল ‘দেখানোর জন্য’।

ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলের একটি ডাইং ফ্যাক্টরির কর্মচারী জানান, আমাদের ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো অনেক পুরানো। একবার ট্রেনিং হয়েছিল তিন বছর আগে। পরে আর কেউ কিছু শেখায়নি।

 অন্যদিকে শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, ফ্যাক্টরিতে নিয়মিত নিরাপত্তা মহড়া হয় না। অনেক স্থানে জরুরি নির্গমনপথে তালা ঝুলিয়ে রাখা হয় যাতে শ্রমিকরা ‘অনুমতি ছাড়া বের না হতে পারে’।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। 

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, ‘শহরের অধিকাংশ শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক ভবন, সুপারমার্কেট ও বহুতল আবাসিক ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নেই। আইন অনুযায়ী প্রতিটি ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, হাইড্রেন্ট সিস্টেম, নির্গমনপথ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই নেই। মালিকেরা আগুন লাগার পরই আমাদের ফোন দেন, আগেই কোনো প্রস্তুতি নেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘নয়ামাটি, নিতাইগঞ্জ, টানবাজার ও উকিলপাড়া এলাকায় এখনও শতাধিক কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে, যেগুলোর কোনোোটিরই যথাযথ অনুমোদন নেই। আমরা প্রায়ই অভিযান চালাই, তদন্ত করি, সতর্ক করি-কিন্তু ব্যবসায়ীরা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেন। এটা একরকম অগ্নিসন্ত্রাসের মতো জীবনযাপন।’

নারায়ণগঞ্জের পুরোনো শহরের অংশ-টানবাজার, নিতাইগঞ্জ ও কালিরবাজার—বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানকার ঘিঞ্জি গলিতে একের পর এক দোকান, গুদাম ও ছোট কারখানা গজিয়ে উঠেছে। অধিকাংশ ভবনই ৫০ থেকে ৭০ বছর পুরানো।

নিতাইগঞ্জ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানদার শওকত আলী বলেন, ‘আমরা এখানে তিন পুরুষ ধরে ব্যবসা করছি। আগুনের ভয় প্রতিদিনই থাকে। গলিগুলো এত সরু যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার জায়গাই নেই। আগুন লাগলে সবাই মিলে বালতি দিয়ে পানি ঢালি, এটাই ব্যবস্থা।’

ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, নিতাইগঞ্জ ও টানবাজার এলাকায় অগ্নিনির্বাপণের তিন স্তরের কোনো কাঠামো নেই। নেই পর্যাপ্ত রাস্তা, নেই পানির উৎস, এবং নেই প্রাথমিক ফায়ারফাইটিং সরঞ্জাম। ফলে একটি ছোট আগুন মুহূর্তেই ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বলেন, ‘আমরা বারবার নোটিশ দিয়েছি, অভিযানও চালিয়েছি। কিন্তু গোডাউনগুলো সরানো যায়নি। তারা আবার অন্য জায়গায় গিয়ে নতুন করে শুরু করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, অনেকের জমিও তাদের নিজের। ফলে প্রশাসনিক পদক্ষেপ স্থায়ী হয় না। আমরা এখন নতুন করে নীতিমালা তৈরি করছি, যাতে কেমিক্যাল ব্যবসাগুলোকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থানান্তর করা যায়।’

ফায়ার সার্ভিসের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল ৩৪৭টি, ২০২২ সালে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৯-এ, আর ২০২৫ সালে (মাত্র ১০ মাসে) তা ৪৮৯টি।

  • ইমতিয়াজ আহমেদ/এমআই

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

অগ্নিকাণ্ড

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর