মাজরা পোকা ও ছত্রাকে বিপর্যস্ত নওগাঁর রোপা আমন মৌসুম
নওগাঁ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৬
ছবি : বাংলাদেশের খবর
উত্তরাঞ্চলের খাদ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত নওগাঁ জেলায় রোপা আমন ধানের মৌসুমে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, ব্লাস্ট ও খোলপচা জাতীয় ক্ষতিকর ছত্রাকের দ্বিমুখী আক্রমণে জেলার বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত এখন ফসলশূন্য হওয়ার পথে। ধান কেটে ঘরে তোলার মাত্র কয়েক দিন আগে এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার কৃষক।
প্রতি বিঘায় সাত থেকে আট হাজার টাকা ব্যয় করেও ফলন না পাওয়ায় ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন তারা।
জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে সদর, মহাদেবপুর, মান্দা, আত্রাই, নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা এবং রাণীনগরের মাঠে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ দেখা গেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ধান পেকে সোনালি হয়ে গেছে, কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায় গাছগুলো হলুদ হয়ে শুকিয়ে গেছে, শীষ চিটা হয়ে সাদা হয়ে পড়েছে। ধানের গোড়ায় পচন এবং পাতায় ছত্রাকের দাগ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
মাজরা পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। এই পোকার কীড়া ধানের কাণ্ডের ভেতর প্রবেশ করে ভেতরের অংশ খেয়ে ফেলে। এতে ধানের থোড় আসার আগেই গাছ মরে যায়, যাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘মরা ডিগ’। আর শীষ বের হওয়ার পর আক্রমণ করলে তা শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়—যাকে বলা হয় ‘সাদা শীষ’ বা ‘চিটা শীষ’।
মাজরা পোকার পাশাপাশি ব্লাস্ট ও খোলপচা নামের ছত্রাকজনিত রোগেও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ব্লাস্ট রোগে ধানের শীষের গোড়া কেটে যাচ্ছে, ফলে শীষ বের হলেও চিটা হয়ে পড়ছে। খোলপচা রোগে গাছের গোড়ায় পচন ধরে পুরো গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে।
নওগাঁ সদর উপজেলার বাচারী গ্রামের কৃষক হামিদুল হক বলেন, ‘পাঁচবার ওষুধ দিয়েও কিছুই কাজে আসেনি। বিঘা প্রতি সাত-আট হাজার টাকা খরচ করেছি, এখন মাঠের ধান খড় হয়ে গেছে। মহাজনের ঋণ শোধ করব কী দিয়ে?’
মহাদেবপুর উপজেলার উত্তর গ্রামের কৃষক মাহবুব আলম বলেন, ‘ধান কাটার সময় হয়ে গেছে, অথচ ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে এমন ভয়াবহ আক্রমণ দেখিনি।’
কৃষকদের অভিযোগ, কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাশে পাওয়া যায়নি। ফলে অনেকেই কীটনাশক বিক্রেতাদের পরামর্শে ওষুধ প্রয়োগ করলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাননি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের আবাদ হয়েছিল। কিন্তু দেরিতে বৃষ্টি শুরু হওয়া এবং এর পর তীব্র গরম ও অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে রোগবালাই বেড়েছে।
জেলার কৃষি বিভাগের উপপরিচালক মোছা. হোমায়রা মণ্ডল বলেন, ‘অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে মাজরা পোকা ও ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ বেড়েছে। আমরা মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সক্রিয় করেছি এবং কৃষকদের অনুমোদিত বালাইনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি। পাশাপাশি যত্রতত্র ওষুধ প্রয়োগ না করার জন্যও সতর্ক করছি।’
তিনি আরও বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমি বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হয়েছে। সঠিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ চলছে। আমরা ফলন বিপর্যয়ের মাত্রা কমাতে কাজ করছি।’
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধানের শীষ আসার সময় আবহাওয়ার পরিবর্তন, জমিতে নাইট্রোজেন সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অনুপযুক্ত বালাইনাশক প্রয়োগের কারণেই এ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
তাদের মতে, মাজরা পোকার ডিমের গাদা ধ্বংস, আলোর ফাঁদ ব্যবহার এবং অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ জরুরি। ছত্রাক দমনে কার্বনডাজিম বা টেবুকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক ব্যবহার কার্যকর হতে পারে, তবে তা কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী করাই উচিত।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য সরকার দ্রুত প্রণোদনা ঘোষণা না করলে খাদ্য উদ্বৃত্তের এই অঞ্চলে কৃষিখাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন ও জরুরি সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন।
এম এ রাজ্জাক/এআরএস

