পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বেলুয়া নদীর বৈঠাকাটা ভাসমান হাটে, প্রতি হাটে লেনদেন হয় কোটি টাকার। ছবি : বাংলাদেশের খবর
ভোরের আলো যখন বেলুয়া নদীর শান্ত জলে ছড়িয়ে পড়ে, তখনই নীরবতা ভেঙে ভেসে আসে শতাধিক নৌকার ডাক। নৌকায় কেউ আনছে শাকসবজি, কেউ চাল-ডাল, কেউ বা মাছ, হাঁস-মুরগি, আর নদীতে পাওয়া যায় চা-পিঠা। নদীর বুকে যেন বেজে ওঠে এক অপূর্ব সংগীত। মাঝির বৈঠার ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ, ট্রলারের ইঞ্জিনের চিৎকার, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক আর ঢেউয়ের তালে জেগে ওঠে জনপদ।
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বেলুয়া নদীর বৈঠাকাটা ভাসমান হাটের স্বাভাবিক চিত্র এমন। বৈঠাকাটা হাট দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদীভিত্তিক হাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জানা গেছে, সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এই হাট এলাকার মানুষের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও বাজার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে বেলুয়া নদী শুধু নৌকা বয়ে আনছে না, সঙ্গে নিয়ে আসছে মানুষের জীবনের নানা গল্প। চাষি, ব্যবসায়ী, মাঝি, খেটে খাওয়া মানুষের সংস্থান নির্ভর করে এই বহমান স্রোতেই। প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নদী বদলে যায় প্রাণচঞ্চল বাজারে। বর্ষায় সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত, শীতে বেলা ১০টা পর্যন্ত চলতে থাকে বেচাকেনা।
 - 2025-11-11T174228-69132118e04bc.jpg)
পিরোজপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার উত্তরে এবং নাজিরপুর উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বৈঠাকাটা হাটে পৌঁছাতে হয় নৌকায়। কারণ, নাজিরপুরের এই অঞ্চল মূলত বিলাঞ্চল, যেখানে সড়কপথের চেয়ে নৌপথ সহজলভ্য। ভাসমান হাটে স্থানীয় প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়-শাকসবজি, চাল-ডাল, মাছ-মাংস, গাছের চারা, শ্যাওলা, হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে নাশতার দোকান পর্যন্ত। পিরোজপুর ছাড়াও বরিশাল, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট ও শরীয়তপুর জেলার ব্যবসায়ীরাও এখানে আসে।
বছরের পর বছর ধরে এই বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে আব্দুল হকের। তিনি বলেন, ‘এখান থেকে চারা ও সবজি পাইকারি কিনে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ, বৈঠাকাটা, বাগেরহাটের মোংলা ও শরনখোলা, মোরলগঞ্জে খুচরা বিক্রি করি। প্রথমে ডিঙি নৌকা ব্যবহার করতাম, এখন বড় স্টিলের ট্রলার আছে। এখানে চারা ও সবজির মান ভালো, ফলে ক্রেতার অভাব হয় না।’
নাজিরপুর উপজেলার পার্শ্ববর্তী বিশারকান্দি এলাকার পাইকারী ব্যবসায়ী এনায়েত বাহদুর বলেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে এই বাজারের সঙ্গে জড়িত। এখান থেকে মাল কিনে ভোলা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রি করি। এ হাটের সঙ্গে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ জড়িত। নৌযান ছাড়া যোগাযোগের কোনো মাধ্যম এখনো নেই।’
স্থানীয় কৃষক আজাদ শেখ বলেন, ‘নিজের উৎপাদিত সবজি ও চারা বিক্রি করতে স্থানীয় সোনাপুর গ্রাম থেকে আসি। আগে বাবা সঙ্গে আসতেন, এখন নিজে আসি। সরকার যদি আমাদের দেখত, তাহলে আমরা এত অবহেলিত হতো না।’
ভাসমান হাট থেকে তরকারি কিনে লঞ্চে করে ঢাকা পাঠাতেন লাবু মোল্লা। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না। লঞ্চ বন্ধ থাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়েছে। গাড়ি ব্যবহারে সমস্যা থাকায় পণ্য পাঠানোও কঠিন।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাসানত ডালিম জানান, ‘ভাসমান হাটকে ঘিরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল সরাসরি বিক্রি করেন, ফলে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কম এবং কৃষক ন্যায্য দাম পান। প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হয়।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজিয়া শাহনাজ তমা বলেন, ‘বৈঠাকাটা ভাসমান বাজারটি বাংলাদেশের বৃহত্তম ভাসমান বাজার। বাজারটির বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সমাধানের জন্য আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা করছি এবং দ্রুত তা বাস্তবায়ন করা হবে। বৈঠাকাটা শুধু একটি বাজার নয়, এটি নদীভিত্তিক দক্ষিণাঞ্চলের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। নৌকাভিত্তিক এই হাট গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক।’
- সৈয়দ বশির আহম্মেদ/এমআই

