ছবি : বাংলাদেশের খবর
উত্তরবঙ্গের 'শস্যভাণ্ডার' খ্যাত নওগাঁর মাঠে কৃষকের চোখে থাকার কথা ছিল সোনালী স্বপ্ন। দিগন্তজোড়া আমন ধানের পাকা ফসলের দৃশ্যে আনন্দের ঢেউ থাকার কথা। কিন্তু মাঠভরা ফসলের উল্টো চিত্র এখন কৃষকের হৃদয়ে। ভালো ফলনের আভাস থাকলেও উৎপাদন খরচের লাগামহীন বৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক মৌসুমী দুর্যোগ জেলার লক্ষাধিক কৃষকের জীবনকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। নওগাঁর কৃষি এখন 'স্বর্ণের রঙেও বিষাদ'-এর প্রতিচ্ছবি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে জেলায় মোট ১ লাখ ৯৩ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছিল। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। তবে কৃষকরা বলছেন, এই ভালো ফলনের সুবিধা গ্রাস করে নিয়েছে অস্বাভাবিক ব্যয়।
কৃষি উপাদানের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে চাষিরা জানান, গত এক বছরে বীজ, সার, কীটনাশক এবং বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়ায় সেচ ও পরিবহন ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে শ্রমিকের দৈনিক মজুরি বেড়ে যাওয়ায় ধান কাটার সামগ্রিক খরচ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
সদর উপজেলার অভিজ্ঞ কৃষক আব্দুল মতিন হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ১৬-১৮ হাজার টাকার কাছাকাছি। গত বছরও যা ছিল ১৪-১৫ হাজার। অথচ বাজারে ধানের দাম সেই হারে বাড়েনি। প্রতি মণে অন্তত ১৮০০ টাকা না পেলে আমাদের লগ্নির টাকাও উঠবে না। এই ধান বিক্রি করে ঘরে লাভ তো দূরের কথা, দেনা শোধ করতে হবে উল্টো ধার করে। মাঠ ভরা ফসল দেখছি, কিন্তু মনটা খালি।’
কৃষকদের এই অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়েছে প্রকৃতির নির্মমতা। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে সৃষ্ট অসময়ের ব্যাপক বৃষ্টিপাতে কৃষকের পাকা ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
নওগাঁ ডিএই-এর তথ্যমতে, এই দুর্যোগে জেলার প্রায় সাড়ে আট হাজার হেক্টর জমির পাকা ধান ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। ধান ভিজে যাওয়ায় শুধু ফলন কমেনি, ধানের মানও খারাপ হয়েছে, যার কারণে বাজারে আরও কম দামে বিক্রি করতে হবে।
আরেক কৃষক মজিবুর রহমান ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের পরিশ্রমের মূল্য কোথায়? একদিকে বাড়তি খরচের বোঝা, অন্যদিকে ভিজে যাওয়া ধানের কম দাম। আমরা কি শুধু ফসল ফলাব, নাকি বেঁচে থাকার জন্য কিছু লাভও করব?’
এমন পরিস্থিতিতে কৃষকদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ।
নওগাঁ জেলা কৃষি উপপরিচালক হুমায়রা মন্ডল সরকারি পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘কৃষকদের সমস্যাটি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে বিবেচ্য হলেও, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য আমাদের করণীয় রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। দ্রুতই সরকারি প্রণোদনা ও অন্যান্য সহায়তা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। আমরা আশাবাদী, কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করতে পারব।’
তবে কৃষকরা মনে করছেন, সাময়িক প্রণোদনার চেয়ে জরুরি হলো ধানের ন্যায্য ক্রয়মূল্য নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি ক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে সরাসরি প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা করা এবং জাতীয়ভাবে ধানের একটি যুক্তিসংগত সহায়ক মূল্য ঘোষণা করাই নওগাঁর কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। অন্যথায়, এই শস্যভাণ্ডার কৃষকের দীর্ঘশ্বাসের কেন্দ্রে পরিণত হবে।
- এম এ রাজ্জাক/এমআই

