শতবর্ষ পেরিয়ে জীর্ণতায় ডুবছে বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজ
শেখ আবু তালেব, বাগেরহাট
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:১০
ছবি : বাংলাদেশের খবর
শত বছরের পথচলা। অথচ অবকাঠামো যেন ক্লান্ত ছায়াগাছ—ইটের শরীরে ফাটল, দেয়ালে জীর্ণতার ছাপ। তবু জ্ঞান-আলোকের আশায় দাঁড়িয়ে আছে বাগেরহাট সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) কলেজ। সময়ের ক্ষয়ে ক্ষয়ে নুয়ে পড়লেও স্বপ্ন অটুট; কিন্তু হাজারো শিক্ষার্থীর মনে একটাই প্রশ্ন—কবে বদলাবে তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানের দিন?
দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শত বছর পূর্ণ করলেও শিক্ষক-সংকট, জীর্ণ ভবন, আবাসন সমস্যা, বিভাগীয় সীমাবদ্ধতা—সব মিলিয়ে নানা সংকটে জর্জরিত। একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কার্যকর সমাধান মেলেনি বলে জানিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কলেজ সূত্র জানায়, বর্তমানে সরকারি পিসি কলেজে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। অথচ ৬৮টি অনুমোদিত শিক্ষকের পদের মধ্যে ৩৩টি শূন্য। প্রভাষক পদে ৩৪টির মধ্যে ১৩টি, সহকারী অধ্যাপক পদে ১৭টির মধ্যে ৯টি এবং সহযোগী অধ্যাপক পদে ১৪টির মধ্যে ৯টি শূন্য। অধ্যক্ষের জন্য নির্ধারিত ৩টি পদের মধ্যে ২টিও এখনো খালি।
-6922f8ec0d3b0.jpg)
১৯১৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ এখনো পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো পায়নি।
কলেজের পাঁচটি ভবনের দুইটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে থাকা উচিত ৮৪টি শ্রেণিকক্ষ, সেখানে ব্যবহারের উপযোগী কক্ষ আছে মাত্র ৪টি—তাও বেশিরভাগ আংশিক ভগ্নদশায়। পর্যাপ্ত ক্লাসরুম না থাকায় নিয়মিত পাঠদান মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। নেই কোনো আধুনিক অডিটোরিয়াম বা সেমিনার হল। বিভাগীয় ১১ কার্যালয়ের মধ্যে ৫টির অবস্থা নাজুক।
শিক্ষক-সংকটও জটিল আকার ধারণ করেছে। অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের প্রতিটি বিভাগে থাকার কথা ১২ জন শিক্ষক। অথচ কোনো কোনো বিভাগে আছে মাত্র ১ জন, কোথাও ২–৪ জন শিক্ষক দিয়ে চলছে পুরো বিভাগ। ফলে একই শিক্ষককে একাধিক কোর্স ও অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হচ্ছে; শিক্ষার্থীরাও পাচ্ছে না মানসম্পন্ন পাঠদান।
সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট—কোনোটিরই আলাদা ভবন নেই। ১১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য পরিবহন সুবিধা বলতে আছে একটি মাত্র ৪৫ সিটের বাস।

মনোবিজ্ঞান, সমাজকল্যাণ, ভূগোল, কৃষিশিক্ষা, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, মার্কেটিং, পরিসংখ্যান—এই বিষয়গুলো চালু না থাকায় প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হতে পারছে না।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত বলেন, পরিত্যক্ত ভবনে ক্লাস করতে ভয় লাগে। কিন্তু নতুন ভবন না থাকায় বাধ্য হয়ে ওই ঝুঁকি নিয়েই পড়তে হয়।
অনার্স প্রথম বর্ষের মেহেদী হাসান বলেন, বাথরুম সংকট আমাদের প্রতিদিনের দুর্ভোগ। টয়লেট ভাঙা, পানি থাকে না, দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না। এত বড় কলেজে আধুনিক বাথরুম তো জরুরি প্রয়োজন।
উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী নমাহিন আক্তার বলেন, ভবনের ফাটল, ছাদ খসে পড়া—সব মিলিয়ে আতঙ্ক নিয়ে ক্লাস করতে হয়। নতুন ভবন ছাড়া এই সংকট কাটবে না।
মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সোহেল রানা বলেন, সেমিনার হল না থাকায় অনার্স-মাস্টার্সের ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, গ্রুপ আলোচনাসহ সব কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হয়।

অনার্স চতুর্থ বর্ষের বিজয় বলেন, ক্লাসরুম সংকট, বাথরুমের করুণ অবস্থা, ভবনের জীর্ণতা—সব মিলিয়ে পড়াশোনার মান কমে যাচ্ছে। আমরা সাহায্য চাই না, ন্যূনতম অধিকার চাই।
বাংলা বিভাগের প্রভাষক তাপশ কুমার চন্দ্র ঘরামী বলেন, হল সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী থাকার জায়গা না পেয়ে বিপাকে পড়ছে। শিক্ষক নিয়োগ, নতুন ভবন নির্মাণ ও নতুন বিভাগ চালুর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান সরদার রইস উদ্দিন বলেন, আমার বিভাগে শিক্ষার্থী আছে, ক্লাস আছে—কিন্তু শিক্ষক নেই। দীর্ঘদিন ধরে এই সংকট চলছে।
প্রভাষক নিপুণ মণ্ডল বলেন, ভবন সংকট, শ্রেণিকক্ষ সংকট ও শিক্ষক স্বল্পতা—এই তিন সমস্যা পুরো ব্যবস্থাকে থামিয়ে দিয়েছে। শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানের এমন অবস্থা মানা যায় না।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ জিয়াউল ইসলাম বলেন, ভবন, শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক স্বল্পতা, বাথরুমসহ অবকাঠামোগত সমস্যার বিষয়ে সচিবালয়ে আলোচনা হয়েছে, লিখিতভাবেও পাঠানো হয়েছে। এত শিক্ষার্থীর জন্য এত কম সুবিধা—এভাবে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া কঠিন। দ্রুত নতুন ভবন, অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ, পর্যাপ্ত শিক্ষক, সেমিনার হল—এসব ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

শত বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সরকারি পিসি কলেজ আজ ভগ্নদশা ভবন, শিক্ষক-সংকট, বিভাগীয় সীমাবদ্ধতা, পরিবহনের অভাব—সব মিলিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। দক্ষিণাঞ্চলের এই বাতিঘর শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন বয়ে নিয়ে চললেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল না থাকায় প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার মান ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা।
স্থানীয়রা মনে করেন, সময় এসেছে পিসি কলেজকে নতুনভাবে সাজানোর। অবকাঠামো আধুনিকায়ন, শ্রেণিকক্ষ বৃদ্ধি, নতুন বিভাগ চালু, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা—এটাই সময়ের দাবি। দ্রুত পদক্ষেপ নিলে শতবর্ষী এই শিক্ষাপীঠ আবারও তার পুরোনো গৌরব ফিরে পাবে।
এআরএস

