তাজরীন ট্র্যাজেডি
১১৭ প্রাণহানির ১৩ বছর পরও সাভারে অগ্নিনিরাপত্তায় অবহেলা
সাইফুল ইসলাম শাওন, সাভার (ঢাকা)
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:৪৪
ছবি : সংগৃহীত
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। বিকেলের শেষ আলো যখন নিশ্চিন্তপুরের আকাশে ম্লান হচ্ছিল, তখনই তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের ভবনটি মুহূর্তেই পরিণত হয় লেলিহান আগুনের অগ্নিগর্ভে। সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ১১৭ শ্রমিক, আহত হন শতাধিক।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে এটি এক বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতি হয়ে আছে। ১৩ বছর পরও সেই রাতের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে—কারও পায়ে রড, কারও একাধিক অস্ত্রোপচারের পরও মিলছে না ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন।
তৃতীয় তলার ক্লিনার আনজু বেগম এখনও শিহরিত হন সেই রাতের কথা ভাবলে। আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর শ্বাস নিতে না পেরে পাঁচতলা থেকে নিচে লাফ দিয়েছিলেন তিনি।
আনজুর বলেন, ‘জান বাঁচাতে লাফ দিয়েছি। দুই পায়ে রড ঢোকানো, হাতে ১৭টা সেলাই, পেটে তিনবার অপারেশন। কষ্ট নিয়ে বাঁচছি। কেউ খোঁজ নেয় না। বিচার পাই না, ক্ষতিপূরণও পাই না।’ ১৩ বছরেও তার ভাগ্যে জোটেনি পুনর্বাসন।
তাজরীনের আগুনের পর ধারণা ছিল সাভারের গার্মেন্টস, কলকারখানা ও বাণিজ্যিক ভবনগুলো অন্তত অগ্নি–নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক হবে। কিন্তু বাস্তচিত্র এখনো হতাশাজনক। বিপণিবিতান, মার্কেট, আবাসিক ভবন—বেশিরভাগ জায়গায়ই নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, নেই প্রশিক্ষণ, নেই জরুরি নির্গমনের উপযুক্ত ব্যবস্থা।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের ইউসুফ টাওয়ারের ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বলেন, ‘আগুন লাগলে কী করতে হবে—এটা আমরা কেউই জানি না। কখনো কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। মার্কেটে যন্ত্রপাতিও খুব কম।’
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সাভারে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ২৬৯টি। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আগুন লেগেছে ২৩৪ বার। বেশিরভাগ ঘটনায় কারণ ছিল বিদ্যুৎ–সংক্রান্ত ত্রুটি, গ্যাস লিকেজ, কিংবা অসতর্কভাবে নিক্ষিপ্ত সিগারেট/বিড়ির আগুন।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড সোয়েটার্স ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন বলেন, ‘বাণিজ্যিক ভবন ও শিল্পকারখানায় অগ্নি–নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কি না—এটা কঠোরভাবে তদারকি করা জরুরি। পানি উৎসের অভাব, সরু রাস্তা—এসব কারণে ফায়ার সার্ভিস সময়মতো পৌঁছাতে পারে না। তাজরীনে এত মৃত্যু হলো, কিন্তু বিচার হয়নি, ক্ষতিপূরণও পায়নি অনেকে। পুনর্বাসন আর ক্ষতিপূরণ এখনই নিশ্চিত করতে হবে।’
ঢাকা অঞ্চল–৪ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘সাভারে শিল্পকারখানা বেশি, জনসংখ্যাও ঘন। তাই ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। আমরা নিয়মিত পরিদর্শন, মহড়া ও নোটিশ জারি করছি।’
প্রতি বছরের মতো আজ সকালে নিহতদের পরিবার, আহত শ্রমিক এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন তাজরীনের সামনে স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানাবেন। তাদের দাবি গত ১৩ বছরেও অপরিবর্তিত—ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ভেঙে শ্রমিক আবাসন নির্মাণ, শ্রমিক হাসপাতাল স্থাপন, নিহতদের পরিবারের জন্য আজীবন আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসা–পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ও দায়ীদের বিচার নিশ্চিত করা।
আহত অপারেটর জরিনা বেগম বলেন, ‘১৩ বছরেও বিচার হয়নি, দাবি পূরণ হয়নি। মনে হয় গরিব মানুষের বাঁচার অধিকার নেই। শুনতাম, ওই গার্মেন্টসের মালিক হাসিনা সরকারের লোক ছিল, তাই বিচার পাইনি। এখন তো হাসিনা নেই। ইউনূস স্যার ও তার সরকারের কাছে বলছি—আমাদের অধিকার, ক্ষতিপূরণ আর বিচার নিশ্চিত করুন। আমরা ন্যায়বিচার চাই।’
এআরএস

