বিন্নাদিঘি থেকে নীলসাগর, ইতিহাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভয়ারণ্য
তৈয়ব আলী সরকার, নীলফামারী
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:২৭
ছবি : বাংলাদেশের খবর
নীলফামারীর এক সময়কার বিন্নাদিঘি এখন ‘নীলসাগর’ নামে পরিচিত। সাগরের মতো বিশাল জলরাশি না থাকলেও এটি সাগরের মতো দৃষ্টিনন্দন। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে এ দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। হিন্দুধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী, পান্ডবরা কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছর বনবাসে থাকতে বাধ্য হন।
স্থানীয় ইতিহাস বলছে, নির্বাসিত পান্ডবদের পানির চাহিদা মেটাতে বৈদিক রাজা বিরাট এ দীঘি খনন করেন। কালক্রমে এর নাম হয়ে যায় বিরাট দীঘি, বিল্টা দীঘি এবং অবশেষে বিন্নাদিঘি। কেউ কেউ মনে করেন, রাজার একমাত্র মেয়ে বিন্নাবতীর নাম অনুসারে নামকরণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে আধুনিকায়নের পর জেলা নামানুসারে এটি ‘নীলসাগর’ নামে পরিচিত হয়।

নীলসাগর জেলা শহর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ১৫ কিলোমিটার দূরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোপা ডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত। দীঘির আয়তন ৫৩.৯০ একর, যার জলরাশি ৩৩ একর। পানির গভীরতা ৩০–৩২ ফুট। পাড়ের গাছপালা ও অন্যান্য আকর্ষণীয় স্থান ২০.৯০ একর।
দীঘিতে ১৫–২০ কেজি ওজনের মাছও রয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে মৎস্যশিকারীরা এখানে আসে। ২৪ ঘণ্টার টিকিটের মূল্য ২৫ হাজার টাকা। সাধারণ দর্শনার্থীর জন্য প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা, মোটরসাইকেল ৫০ টাকা, মাইক্রোবাস পার্কিং ১০০ টাকা, বড় বাস ২০০ টাকা। রেস্ট হাউসে রাত্রীযাপন ১,০০০–১,৫০০ টাকা। নীলসাগরের বার্ষিক আয় ২০–২৫ লাখ টাকার বেশি।
দীঘির সৌন্দর্য সহজেই মন মাতিয়ে নেয়। ছায়াযুক্ত পরিবেশ, বিভিন্ন গাছপালা, প্রকৃতির নিসর্গ, অতিথি পাখির কলতান, মন্দির ও মসজিদ—all মিলিয়ে শান্তি উপহার দেয়। পানিতে ঘুরতে এমপিট বোড রয়েছে। শীতকালে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির কলতান এখানে পরিবেশকে মুখর করে তোলে।

জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নীলসাগরে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পৌর প্রশাসক সাইদুল ইসলাম জানান, ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘সারাদেশে পুকুর, খাল উন্নয়ন (২য় সংশোধিত) প্রকল্পের’ আওতায় নীলসাগরের উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। জেলা পরিষদের অর্থায়নে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে পানির ওপর দৃষ্টিনন্দন গোলঘর, ওয়াকওয়ে ও নীলসাগর পাড়ে এভিয়ারী নির্মাণের কাজও চলছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নীলসাগর বিখ্যাত। পাড়ে রয়েছে নারিকেল, বনবাবুল, আকাশমণি, দেবদারু, মেহগনি, বেতগাছ, শিশুগাছসহ বিভিন্ন ফুল ও ফলের বৃক্ষরাজি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বিভিন্ন অতিথি পাখির সমাগম ঘটে—রাজহাঁস, মার্গেঞ্জার, মাছরাঙা, ভুবনচিল, সবুজ চান্দি ফুটকি, বাচাল নীল ফুটকি ইত্যাদি।

১৯৯৮ সালে নীলসাগরকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আলহাজ রাশেদ মোশারফ এ অভয়ারণ্যের উদ্বোধন করেন। প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায় বারুণী স্নান মেলার আয়োজন করে। মেলায় মাটির তৈজসপত্র, পিঠা, চিনির বাতাসা ও গুড়ের জিলাপি, বসে জারি সারি ও মাটিয়া গানের আসর হয়।
পাহারাদার কাম মালি মজিবর রহমান ও হায়দার আলী জানান, প্রতিদিন শতশত মানুষ ভ্রমণে আসে। ৮ জন পর্যবেক্ষক দিয়ে দীঘি দেখা হয়। তবে চারপাশের সীমানা প্রাচীর কম হওয়ায় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও জেলা পরিষদের অর্থায়নে ওয়াকওয়ে, গোলঘর এবং এভিয়ারী নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
-6926c70223f62.jpg)
উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মো. আব্দুল জব্বার নীলসাগরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত করান। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান ভ্রমণের জন্য দর্শনার্থীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ঢাকা থেকে সড়ক, বিমান বা রেলপথে সৈয়দপুরে এসে বাস, মাইক্রোবাস ও রিকশাভ্যানে যাওয়া সম্ভব।
এআরএস

