স্মৃতির সোনালি ধান, ধূসর হেমন্ত
জৌলুস হারিয়েছে চলনবিলের নবান্ন
তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:৩৬
হেমন্তের বাতাসে এখন আর নতুন ধানের সেই মাতাল করা গন্ধ নেই। কৃষকের উঠোনজুড়ে নেই ধান মাড়াইয়ের ব্যস্ততা। আর ঢেঁকির তালে মুখর হয় না গাঁয়ের বধূদের নবান্নের গীত।
যে চলনবিল একদিন নবান্নকে ঘিরে সার্বজনীন উৎসবে মেতে উঠত, আজ সেখানে কেবলই একরাশ শূন্যতা আর স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস। কালের চাকায় পিষ্ট হয়ে বাঙালির হাজার বছরের এই প্রাণের উৎসব তার চিরায়ত রূপ ও রং হারিয়ে এখন বিবর্ণ, জৌলুসহীন।
স্মৃতির পাতা উল্টালে চোখে ভাসে এক অন্য চলনবিল। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকেও সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর ও নওগাঁর বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে আমন ধানের সোনালি ঢেউ খেলত। সাদা দিঘা, সরসরিয়া, লাউজাল, মাটিয়াগড়লের মতো বিলুপ্তপ্রায় সব দেশি জাতের ধান কাটার মধ্য দিয়েই শুরু হতো মহোৎসবের প্রস্তুতি।
কৃষকেরা সারা রাত জেগে চাদর গায়ে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করতেন। সেই নতুন ধানের প্রথম অংশটুকু বাড়ির গিন্নি তুলে নিতেন পিঠা-পায়েসের জন্য। নবান্ন তখন শুধু একটি দিন ছিল না, ছিল পৌষ মাস পর্যন্ত বিস্তৃত এক আনন্দযজ্ঞ। ঘরে ঘরে নতুন খেজুরের রসের সঙ্গে গাভি বা মহিষের ঘন দুধ মিশিয়ে তৈরি হতো পুলি, পাকান, ভাপা, কুশলি, পাটিসাপটার মতো রসনাবিলাসী সব আয়োজন।
অনেক গ্রামে আবার বসত সম্প্রীতির এক দারুণ উদাহরণ— বারোয়ারি ডেকচিতে রান্না হতো নতুন চাল-ডালের খিচুড়ি আর পায়েস। ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কলাপাতা বিছিয়ে একসঙ্গে বসে সেই খাবার খেতেন। উৎসবের রং ছড়াত গ্রামের মাঠেও।
দিনের আলোয় লাঠি খেলা, পুঁথিপাঠ, সাঁতার আর হাঁড়ি ভাঙার মতো গ্রামীণ খেলাধুলায় মুখর থাকত চারপাশ। আর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দূর থেকে ভেসে আসত কবিগান, জারিগান আর যাত্রাপালার সুর। নবান্ন ছিল একাধারে ফসল, সংস্কৃতি আর সামাজিক ঐক্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। আজকের চলনবিলে সেই প্রাণবন্ত দৃশ্যপট কেবলই ইতিহাস। এর পেছনের কারণগুলো বহুমাত্রিক ও গভীর।
উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের দাপটে হারিয়ে গেছে সেই সুগন্ধি দেশি ধান। ট্র্যাক্টর ও হারভেস্টারের যান্ত্রিক শব্দে চাপা পড়েছে ধান মাড়াইয়ের লোকগান। কৃষিকাজ এখন আর উৎসব নয়, নিছকই এক বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া। বহু কৃষক এখন আর মাটির সঙ্গে বাঁধা নেই। জমি লিজ দিয়ে তারা এখন শহুরে জীবনের দিকে ঝুঁকছেন।
অন্যদিকে, একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় কমে গেছে সম্মিলিত আয়োজনের উৎসাহ। গ্রামের সেই আন্তরিকতার জায়গায় এখন দানা বেঁধেছে দলাদলি, মামলা-মোকদ্দমা আর বিচ্ছিন্নতা। আকাশ সংস্কৃতি আর হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোন কেড়ে নিয়েছে লোকজ সংস্কৃতির আবেদন। নতুন প্রজন্মের কাছে লাঠি খেলা বা জারিগানের চেয়ে ডিজিটাল বিনোদন অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ফলে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রবাহ প্রায় থেমে গেছে।
এখনো কিছু পরিবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করে নবান্নের স্মৃতিটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু খণ্ড খণ্ড এই প্রচেষ্টাগুলো সার্বজনীন উৎসবের সেই হারিয়ে যাওয়াকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ। প্রবীণদের মুখে আজও ভাসে সেই সোনালি দিনের গল্প, যখন নবান্ন ছিল একতার প্রতীক, আনন্দের উপলক্ষ্য আর হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল।
কালের পরিক্রমায় চলনবিলের নবান্ন আজ তার জৌলুস হারিয়ে এক ধূসর ক্যানভাসে পরিণত হয়েছে, যা কেবল একটি উৎসবের মৃত্যু নয়, বরং একটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয়েরই সংকট।
ফিরোজ আল আমিন/এনএ

