বোরো মৌসুমে লবণ–পানি সংকট : আশার আলো দেখাচ্ছে বিনা ধান–১০
আব্দুস সামাদ, সাতক্ষীরা
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৩৫
ছবি : বাংলাদেশের খবর
বোরো মৌসুম সামনে। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই শুরু হবে বীজতলা তৈরির কাজ। কিন্তু সেচ সংকট ও লবণাক্ততার চিন্তায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শ্রীফলকাটি গ্রামের কৃষক ফরিদ হোসেন। একই সংকটে গত মৌসুমে ফসল হারিয়েছেন আটুলিয়ার হাওয়ালভাঙ্গী গ্রামের কৃষক রুহুল আমিনও।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সেচ সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন—উপযুক্ত জাত নির্বাচন, জৈব সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষ করে জমির পাশে মিনি পুকুর খনন করে সেচের সুবিধা পেলে কৃষকরা উপকৃত হবেন।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) সাতক্ষীরা উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মিলন কবীর জানান, উপকূলীয় এলাকায় বোরো ধান চাষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ লবণাক্ততা ও পানির অভাব। তাই লবণসহিষ্ণু আগাম জাত নির্বাচনই উত্তম। তার ভাষায়, বিনা ধান–১০ এ অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।
ব্রি, বিনা এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে লবণসহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে। সরকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে এসব জাত কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
বিনা ধান–১০ একটি আগাম, উচ্চফলনশীল এবং লবণসহিষ্ণু বোরো জাত। অন্যান্য জাতের তুলনায় এটি ১০–১৫ দিন আগে কাটা যায়। জীবনকাল ১২৫–১৩০ দিন। কুশি পর্যায় থেকে পরিপক্কতা পর্যন্ত ১০–১২ ডিএস/মিটার এবং চারা পর্যায়ে ১২–১৪ ডিএস/মিটার লবণ সহ্য করতে পারে। লবণাক্ত জমিতে এর ফলন হেক্টরে ৫.৫ টন এবং স্বাভাবিক জমিতে ৮.৫ টন পর্যন্ত হয়।
মিলন কবীর আরও জানান, জেলার কলারোয়া, তালা ও সাতক্ষীরা সদরের জন্য উপযোগী অন্য একটি জাত হলো বিনা ধান–২৫। ১৪৩–১৪৫ দিনের এই জাতটির গড় ফলন ৭.৬ টন/হেক্টর।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সাতক্ষীরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান জানান, ব্রি ধান–৬৭, ৯৭ ও ৯৯—এ তিনটি জাতও লবণাক্ত এলাকার উপযোগী।
ব্রি ধান–৬৭ চারা অবস্থায় ১২–১৪ ডিএস/মিটার এবং অংগজ পর্যায় থেকে প্রজনন পর্যায় পর্যন্ত ৮ ডিএস/মিটার লবণ সহ্য করতে সক্ষম। জীবনকাল ১৪০–১৫০ দিন। ফলন ভেদে হেক্টরপ্রতি ৩.৮–৭.৪ টন উৎপাদন সম্ভব।
ব্রি ধান–৯৭ অংগজ থেকে প্রজনন পর্যায়ের প্রতিটি ধাপে ৮–১০ ডিএস/মিটার লবণ সহ্য করতে পারে। জীবনকাল ১৪৮–১৫৫ দিন, গড় ফলন ৪.৮৯ টন/হেক্টর।
ব্রি ধান–৯৯ চারা পর্যায়ে ১৪ ডিএস/মিটার পর্যন্ত লবণ সহ্য করতে পারে। জীবনকাল ১৪৮–১৫৭ দিন, গড় ফলন ৫.৪ টন/হেক্টর।
এদিকে বিএডিসি সাতক্ষীরা অঞ্চলে এ বছর ব্রি ধান–৬৭, ৮৮, ১০১, ১০২ ও হাইব্রিড এসএল–৮ এইচ সরবরাহ করছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, আশাশুনি ও দেবহাটায় মার্চ–মে মৌসুমে মাটির লবণাক্ততা ১৫–২৫.৪ ডিএস/মিটার পর্যন্ত ওঠে। বর্ষার পর জুলাই–সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ২–৫.৬ ডিএস/মিটারে। ব্রি সাতক্ষীরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যমতে, কালিগঞ্জের কিছু কৃষিজমিতে লবণাক্ততা সর্বোচ্চ ২৫ ডিএস/মিটার পর্যন্ত ওঠে।
-6933dc98d79c7.jpg)
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের মার্চ–জুনে নদীর পানির লবণাক্ততা সর্বোচ্চ ৪০ ডিএস/মিটার পর্যন্ত ছিল; বর্ষায় তা কমে ৯.২২ ডিএস/মিটার হয়।
ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হওয়ায় শ্যামনগর ও কালিগঞ্জে সেচের জন্য পুকুর ও খালের পানি ছাড়া বিকল্প নেই। ফলে বিশাল এলাকা পতিত পড়ে থাকে।
শ্যামনগরের রমজাননগরের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, ব্যক্তিগত পুকুর ও পাশের খালের পানির ওপর ভরসা করে চাষাবাদ করেন তিনি। কিন্তু সবার সেই সুযোগ নেই।
২০২৪ সালে বারসিক পরিচালিত গবেষণায় সুপারিশ করা হয়—প্রতিটি গ্রামে বড় জলাধার খনন, চিংড়ি চাষে নীতিমালা অনুসরণ, বিদ্যমান খাল–পুকুরের ইজারা বাতিল করে জনসাধারণের ব্যবহারে উন্মুক্ত করা এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার।
বিএডিসি সাতক্ষীরা সেচ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. ইবনে সিনা জানান, খাল খনন ও স্বাদু পানি সরবরাহ বৃদ্ধিতে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু হলে কিছু এলাকায় সেচ সংকট দূর হবে।
সাতক্ষীরায় আমনের তুলনায় বোরো মৌসুমে আবাদ কমছে। বিশেষ করে লবণাক্ততা–প্রবণ শ্যামনগর ও কালিগঞ্জে কমে যাবে অন্তত ২৫ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে।
জেলায় আমন আবাদ হয়েছিল ৮৯ হাজার ১৪৫ হেক্টরে। বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৮০০ হেক্টর। শ্যামনগর ও কালিগঞ্জে আমনের তুলনায় বোরো আবাদ কমবে আশংকাজনক হারে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদার মতে, ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হওয়ায় বিশাল এলাকা অনাবাদি থেকে যায়। মিনি পুকুর খনন ও খালগুলোকে মিষ্টি পানির উৎসে পরিণত করা গেলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
কালিগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওয়াসিম উদ্দিন জানান, অতীতে সাড়ে চার হাজার হেক্টরে বোরো চাষ হতো; খাল খনন ও সেচ সুবিধা বৃদ্ধির ফলে এখন তা প্রায় সাত হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে।
তিনি বলেন, সারাদেশে বোরো ধানের প্রধান মৌসুম হলেও কালিগঞ্জে সেচ সংকটের কারণে আমনই মূল উৎপাদন মৌসুম। তবে বোরো মৌসুমে ফলন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় সেচ সুবিধা বাড়লে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
এআরএস

