Logo

সারাদেশ

মেগা প্রকল্পের কাজে অনিয়ম ও ধীরগতি

উপকূলে অশনিসংকেত, অসময়েও ভাঙছে বাঁধ

Icon

তরিকুল ইসলাম, খুলনা

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:১৫

উপকূলে অশনিসংকেত, অসময়েও ভাঙছে বাঁধ

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের মাটিয়াডাঙ্গার ভেঙে যাওয়া স্থানে রিং বাঁধ দিয়ে আটকানোর পর মূল বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা চলছে। ছবি : বাংলাদেশের খবর

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে নদী ভাঙনে প্লাবিত হওয়া খুলনার কয়রা উপজেলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রতিবছর গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে কয়রার মানুষ চরম আতঙ্কে থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তন, জোয়ার–ভাটার তীব্রতা এবং নদীর গতিপ্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ছে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা উপকূলীয় এ অঞ্চলের।

এদিকে উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত টেকসই বাঁধ নির্মাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের অনুমোদনে আশার আলো জাগলেও কাজের ধীরগতি ও অনিয়মে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

মেগা প্রকল্পে যথেষ্ট বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বাঁধ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া গাছ কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে নদীর চরের সবুজ বনায়ন, যার ফলে বাঁধের স্থায়িত্ব কমছে।

জানা যায়, ৩ ডিসেম্বর রাতে কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দোশহালিয়া থেকে হোগলার মধ্যকার একটি অংশের বাঁধে ফাটল ধরেছিল।

স্থানীয়রা সেখানে মাটি দিয়ে মেরামত করেন। এছাড়া নদীতে পানির চাপ বা কোন ধরনের ঝড়ো বাতাস ছাড়াই ৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের মাটিয়াভাঙ্গা এলাকায় প্রায় ২০০ মিটার বেড়িবাঁধ ধসে পড়ে।

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নদীতে ভেঙে পড়ে বিশাল অংশ। এলাকা প্লাবিত হয়। পরের দিন ভাটায় স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে সক্ষম হলেও আতঙ্ক কাটেনি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত ১১টার পর থেকেই নদীর পাড়ের মাটি সরে যাওয়ার অস্বাভাবিক শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরে তারা সেখানে গিয়ে দেখেন বড় বড় খণ্ড নদীতে ধ্বসে পড়েছে এবং প্রায় ২০০ মিটার বাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী বাঁধ সংস্কার এবং নদী খননে অবহেলার কারণে এ অঞ্চলে ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ধানচর, শামুকপোতা, কুতুবেরচর, গাবতলা ও খোলপেটুয়া পাড়ের বেশ কয়েকটি এলাকা ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

মাটিয়াভাঙ্গার বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ তখনকার ভয়াবহ মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘চোখের সামনে দিয়ে বাঁধটি নদীতে চইলে গেল। মনে হচ্ছিল, আজই সব শেষ, বাড়ি-ঘর সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে।’

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম জানান, ‘প্রতিদিনই নদী এগিয়ে আসছে। কয়েক দিনের মধ্যে তিনটি বাড়ি নদীতে চলে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ থাকলেও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফাটল ছিল এক মাস ধরে—তবু কেবল বালুর বস্তা ফেলে কাজ করা হয়েছে।’

মাটিয়াভাঙ্গার ভেঙে যাওয়া অংশটি মেগা প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় দুই বছর ধরে বিভিন্ন প্যাকেজের কাজ চলমান থাকলেও ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। মাটিয়াডাঙ্গার ওই অংশটি দীর্ঘদিন নাজুক অবস্থায় থাকলেও ঠিকাদার সংস্কারে গুরুত্ব দেয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘পুনর্বাসন’ প্রকল্পের আওতায় কয়রা উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের দুটি পোল্ডারে (১৪/১ ও ১৩–১৪/২) প্রায় ১,২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে উচ্চতা–প্রশস্ততা বৃদ্ধি, ঢাল সংরক্ষণ, নদী শাসন ও চরবনায়নের কাজ করা হচ্ছে। মাটিয়াভাঙ্গার ভাঙন এলাকাটিও এই প্রকল্পের অংশ।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. দিদারুল আলম বলেন, ‘সুন্দরবন ঘেঁষা আড়পাঙ্গাসিয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদীর মোহনার পাশে থাকা বাঁধটিতে এক মাস আগেই ফাটল দেখা গিয়েছিল।

বিষয়টি আমরা পাউবোকে জানিয়েছিলাম, তবু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অল্প কিছু বস্তা ফেলে দায়সারা কাজ করা হয়েছিল। তাই রাতেই আগের ফাটল বড় রূপ নিয়ে ধসে গেছে।’

রিং বাঁধে আপাতত রক্ষা—কিন্তু কতদিন?

রাতে গ্রামবাসী ও পাউবো মিলে বিকল্প রিং বাঁধ দিয়ে এলাকা প্লাবিত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। তবে নদীর ভাঙন ঠেকাতে রিং বাঁধ কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। সচেতন মহল বলছে, রিং বাঁধের স্থায়িত্ব খুব স্বল্প। যে কোনো বড় মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। দ্রুত মূল বাঁধ সংস্কার করা না হলে ধ্বসের পরিধি আরও বাড়তে পারে।

উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের আহ্বায়ক এম. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যেখানে বাঁধ তৈরি হচ্ছে, তার আশপাশ থেকেই বালু উত্তোলন করা হয়। এছাড়া নদীর চর থেকে মাটি কেটে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। নদীর চরের গাছ কেটে বনায়ন নষ্ট করা হচ্ছে। এসব কারণে বাঁধের স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০০৯ সালের আয়লার পর থেকে প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে কোনো না কোনো এলাকা ভেঙে গেছে। এ বছর বর্ষা ও গ্রীষ্ম মৌসুমে প্লাবিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলেও শীতকালে এমন ভাঙন হয়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। আমাদের প্রাণের দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। সরকার বরাদ্দ দেওয়ায় আমরা কৃতজ্ঞ। তবে বরাদ্দের সদ্ব্যবহার হচ্ছে না, নিয়ম বহির্ভূতভাবে কাজ হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

এটি কি শুধুমাত্র প্রকৃতির তাণ্ডব, নাকি বাঁধের কাঠামোগত দুর্বলতা—এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে।

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশীর মাটিয়াডাঙ্গা এলাকার মেগা প্রকল্পের কাজ তদারকির দায়িত্বে পাউবো সাতক্ষীরা–২ বিভাগ। ওই বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আলমগীর কবির বলেন,
‘কাজ চলমান অবস্থায়ই বাঁধ ভেঙে গেছে। কংক্রিট ব্লক নির্মাণের সরঞ্জামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাতেই বিকল্প রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো সম্ভব হওয়ায় এলাকা প্লাবিত হয়নি। সকাল থেকে ভাঙা অংশে মেরামতের কাজ চলছে।’

তবে এলাকার বহু মানুষের অভিযোগ—কাজের ধীরগতি, অসমাপ্ত মাটি ভরাট, কোথাও সিসি ব্লক না দেওয়া, আবার কোথাও বালুর বস্তা ফেলার বাকি থাকার কারণে বহু স্থানে ধস বেড়েছে এবং ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

দক্ষিণ বেদকাশীর বাসিন্দা খলিলুর রহমান বলেন, ‘শুধু মাটিয়াভাঙ্গা নয়, এলাকার অনেক জায়গায় কাজ অসমাপ্ত। রাইতের বিপদ কাটলেও আগামী বর্ষার আগে ঠিকমতো বাঁধের কাজ শেষ না হলে বড় বিপদ হবে।’

পাউবো সাতক্ষীরা–২ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে। তবে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা, বরাদ্দ বিলম্ব, বালু–মাটির সংকট এবং নদীর ভাটার সময়ের ওপর নির্ভর করতে হওয়ায় কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। মাটিয়াভাঙ্গার রাতের ধস স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তবে দ্রুত রিং বাঁধ নির্মাণে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো গেছে। সকাল থেকে ভাঙা অংশে কাজ শুরু হয়েছে, এখন আর তেমন ঝুঁকি নেই।’

এআরএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

উপকূল জনদুর্ভোগ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর