তরমুজ চাষের ‘আতুড়ঘর’ চরফ্যাশন, ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা
চরফ্যাসন (ভোলা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:২৩
ছবি : বাংলাদেশের খবর
ভোরের আকাশে সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আবাদি জমিতে শুরু হয় হাজারখানেক অস্থায়ী কৃষি শ্রমিকের কর্মব্যস্ততা। পশ্চিমাকাশে সূর্য ডোবা পর্যন্ত চলে তাদের নিপুণ প্রতিযোগিতা।
কেউ পাওয়ার টিলার চালিয়ে জমি চাষ দিচ্ছেন, কেউ দলবেঁধে জমি প্রস্তুত ও তরমুজ গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত, আবার কেউ সহকর্মীদের জন্য খাবারের যোগান দিতে শামিল হচ্ছেন।
প্রতিদিনের এই কর্মআয়োজন দেখা যায় ৬ হাজার ৪৩৭ একর আয়তনের বিচ্ছিন্ন চর মুজিবনগরে, যা ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার অন্তর্গত। পুরো চরটি তেতুলিয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত। চরের কয়েকটি জায়গায় মানুষের বসতি থাকলেও এক-চতুর্থাংশই আবাদি জমি। নদীপথে খেয়াপারাপারই এখানকার বাসিন্দাদের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো চর ঘুরে এসব শ্রমিকের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা গেছে। প্রধানত রসালো ফল তরমুজ আবাদের জন্য প্রতি বছর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস তারা শ্রম দেন। ফসল তোলার পর আবার নিজ এলাকায় ফিরে যান এসব শ্রমিক।
ক্ষেতের পাশেই ছনের দোচালা ঘর তুলে অস্থায়ী বসতি গড়েছেন তারা। এমন অস্থায়ী বসতির সংখ্যা প্রায় শখানেক। অস্থায়ী শৌচাগারও স্থাপন করেছেন তারা।
গত তিন বছর তরমুজের ফলন ভালো হওয়ায় এ অঞ্চলের তরমুজ চাষিদের মাঝে প্রাণোচ্ছলতা দেখা যাচ্ছে। তেতুলিয়া নদীসহ সংযুক্ত খালগুলোতে মিঠা পানির উৎস থাকায় এ চরে তরমুজের আবাদ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চর কলমি এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রমিক মো. হোসেন।
তিনি বলেন, ‘তরমুজ চাষের জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে তরমুজ বিক্রি পর্যন্ত পরিচর্যার জন্য মাসিক চুক্তিভিত্তিক কাজ করি। আমি প্রতি মাসে ২২ হাজার টাকা করে তিন মাসের চুক্তিতে কাজ করছি। থাকা-খাওয়া চাষির দায়িত্বে। এই জমির পাশের টং ঘরে রাত কাটাই, দিনে কাজ করি।’ মো. হোসেনের মতো একই চরে হাজারখানেক শ্রমিক তরমুজ চাষের জমিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এ সময় তরমুজ গাছের পরিচর্যা করছিলেন মুজিবনগর ইউনিয়নের তরমুজ চাষি মো. ইসমাইল। তিনি বলেন, ‘১৩ একর জমিতে থাই সুপার, থাই কিং ও আরলি ওয়ান জাতের তরমুজ চাষ করেছি। গত বছর ১৫ গন্ডা জমির তরমুজ ৮ লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। ইনশাল্লাহ এ বছর ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারব। মোট খরচ হবে প্রায় ২০ লাখ টাকা। যেহেতু আগাম চাষ করেছি, তাই তরমুজ কেজি দরে বিক্রি করব। আমার জমিতে ৬ থেকে ১০ কেজি ওজনের তরমুজ রয়েছে।’
একই এলাকার কৃষক রাকিব হোসেন ৩ কানি (৪৮০ শতাংশ) জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। কানিপ্রতি ৩০ হাজার টাকা লগ্নি নিয়ে তার মোট খরচ দাঁড়াবে সাড়ে চার লাখ টাকা। তিনি ১১ থেকে ১২ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রির আশা প্রকাশ করেছেন। পাশের ৬ কানি (৯৬০ শতাংশ) জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন কৃষক আবুল হাসেম। তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কানিপ্রতি ৩২ হাজার টাকা লগ্নি দিয়েছেন। তার খরচ হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টাকা।
ওই চরের আবাদি জমির মালিকরা জানান, প্রতি কানি (১৬০ শতাংশ) জমিতে তারা ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লগ্নি দিয়েছেন, যা গত বছর ছিল ২২ থেকে ২৬ হাজার টাকার মধ্যে। তরমুজ চাষের জন্য অনেক কৃষক গত বছরই লগ্নির টাকা জমা রেখেছিলেন।
কৃষি ব্যাংক চরফ্যাসন শাখার ব্যবস্থাপক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গত বছর কৃষকদের কৃষি প্রণোদনার আওতায় ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হলেও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত আমরা ১২ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে থাকি। বিনা জামানতে বর্গাচাষি কৃষকদেরও ঋণসহায়তা দেওয়া হয়। কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা কৃষকদের ঋণ প্রদান করি।’
উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১০ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। চলতি মৌসুমে তরমুজের আবাদ গত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নাজমুল হুদা বলেন, ‘চরফ্যাসন উপজেলার চরাঞ্চলগুলো তরমুজ চাষের ‘আতুড়ঘর’। এখানকার মাটি খুবই উর্বর। এই উপজেলায় ৬ হাজার তরমুজ চাষি রয়েছেন। তরমুজ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। বিশেষ করে মুজিবনগর ইউনিয়নে ৫ হাজার একর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের এই এলাকায় তেতুলিয়া নদীতে মিঠা পানির উৎস থাকায় কৃষকরা তরমুজ চাষে বেশি আগ্রহী।’
এম ফাহিম/এআরএস

