ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হত্যা
চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে দিপু দাসকে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয় : র্যাব
ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৩
ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে (২৭) চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার পর উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে র্যাব। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহে আগুন দেওয়া হয় বলে র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে।
শনিবার দুপুরে ময়মনসিংহে র্যাব–১৪-এর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের অধিনায়ক নয়মুল হাসান। তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে পৃথক অভিযান চালিয়ে মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে র্যাব সাতজনকে এবং পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি আরও বলেন, ধর্ম অবমাননার বিষয়টি খুবই অস্পষ্ট। তিনি কী বলেছেন, এটি খোঁজার চেষ্টা করলেও কেউ এটি বলতে পারেনি। কারও সঙ্গে পূর্বশত্রুতা ছিল কি না, সেটি আমরা তদন্ত করে দেখব।
র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার সাতজন হলেন, ভালুকা উপজেলায় হবিরবাড়ী ইউনিয়নের ডুবালিয়াপাড়া এলাকার পাইওনিয়ার্স নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার ফ্লোর ইনচার্জ মো. আলমগীর হোসেন (৩৮), কোয়ালিটি ইনচার্জ মো. মিরাজ হোসেন আকন (৪৬) এবং কারখানার শ্রমিক মো. তারেক হোসেন (১৯), মো. লিমন সরকার (২২), মো. মানিক মিয়া (২০), এরশাদ আলী (৩৯) ও নিঝুম উদ্দিন (২০)।
পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার তিনজন হলেন ভালুকার বাসিন্দা মো. আজমল হাসান (২৬), মো. শাহিন মিয়া (১৯) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. নাজমুল (২১)।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে পাইওনিয়ার্স নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে কারখানা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একপর্যায়ে ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভাজকের একটি গাছে বিবস্ত্র অবস্থায় ঝুলিয়ে মরদেহে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় নিহত দিপুর ছোট ভাই অপু চন্দ্র দাস শুক্রবার ভালুকা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
র্যাবের অধিনায়ক নয়মুল হাসান বলেন, ঘটনার সূত্রপাত হয় বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে। কারখানার ভেতরে কাজ করার সময় দিপুর সঙ্গে বাক্বিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে ফ্লোর ইনচার্জ তাঁকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে উত্তেজিত জনতার কাছে হস্তান্তর করেন। পুলিশে না দিয়ে কেন জনতার হাতে তুলে দেওয়া হলো এবং কেন তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি—এই প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ধর্ম অবমাননার অভিযোগটি খুবই অস্পষ্ট। দিপু কী বলেছেন—সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল কি না, কোনো পূর্বশত্রুতা ছিল কি না—এসব বিষয় তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন সম্ভব হবে।
র্যাব হেফাজতে থাকা ফ্লোর ইনচার্জ আলমগীর হোসেন সাংবাদিকদের জানান, কোম্পানির বাইরে একটি চায়ের দোকানে দিপু মহানবী (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তি করেছেন—এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। শ্রমিকেরা তাঁকে বরখাস্তের দাবি জানান। একই সময় কারখানার বাইরে লোকজন জড়ো হতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। উত্তেজনা সামাল দিতে দিপুকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে উত্তেজিত লোকজন তাঁকে নিয়ে যায়।
এদিকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার তিনজনকে শনিবার দুপুরে আদালতে হাজির করা হয়েছে বলে জানান ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আবদুল্লাহ আল মামুন। তাঁদের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। র্যাবের গ্রেপ্তার করা সাতজনকে পুলিশে হস্তান্তরের পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
নিহত দিপু চন্দ্র দাস প্রায় তিন বছর আগে বিয়ে করেন। তাঁর দেড় বছর বয়সী একটি সন্তান রয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে পরিবারটি। শুক্রবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে রাত ১০টার দিকে পারিবারিক শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
নিহতের ভাই ও মামলার বাদী অপু চন্দ্র দাস বলেন, আমার ভাই কী কারণে মারা গেল, আমরা জানি না। ওরা বলছে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছে, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ নেই। অপরাধ হয়ে থাকলেও আইনের মাধ্যমে বিচার হওয়ার কথা ছিল। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। একই সঙ্গে আমার ভাইয়ের পরিবার কীভাবে চলবে, সে বিষয়েও রাষ্ট্রের সহায়তা প্রয়োজন।
আইএইচ/

