জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার হাসড়া মাজালিয়া গ্রামে উদযাপিত হলো ‘সহজপাঠ পৌষ উৎসব ১৪৩২’।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার হাসড়া মাজালিয়া গ্রামে উদযাপিত হলো ‘সহজপাঠ পৌষ উৎসব ১৪৩২’। শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এটি ছিল উৎসবের দ্বিতীয় আসর।
গ্রামীণ ঐতিহ্য রক্ষা, মেধা অন্বেষণ এবং তরুণ প্রজন্মকে পাঠাভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত এ উৎসব স্থানীয় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
উৎসবের সূচনা হয় শীতের সকাল ৭টায় ঐতিহ্যবাহী ‘রস উৎসব’-এর মাধ্যমে। খেজুরের কাঁচা রস ও গ্রামীণ আমেজে দিনটির শুরু হয়। অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে টাটকা খেজুরের রস পান করেন আতিকুর রহমান সবুজ।
তিনি বলেন, ‘শীতের সকালে খেজুরের রসের স্বাদ বাঙালির আদি ঐতিহ্য। আধুনিকতার চাপে আমরা এসব ভুলতে বসেছি। সহজপাঠ ফাউন্ডেশন এই আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের আবার শিকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। এমন উৎসবে অংশ নিতে পেরে আমি আনন্দিত।’
দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে একটি র্যালি বের করা হয়। র্যালিটি গ্রামের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে উৎসব প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। র্যালিতে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড ও উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যায়।
বিকেলে শুরু হয় জমজমাট বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এতে অংশ নেয় বয়ড়া ইসরাইল আহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় ও রুদ্র বয়ড়া উচ্চ বিদ্যালয়। যুক্তির লড়াইয়ে দর্শক-শ্রোতারা মুগ্ধ হন। প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন দল, রানার্সআপ দল এবং শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়।
এরপর অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। ‘সহজপাঠ কুইজ ফেস্ট ২০২৫’-এ সরিষাবাড়ীর বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
এ বছর প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত হয় ‘সহজপাঠ ফাউন্ডেশন সম্মাননা’। সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য বিশিষ্ট সমাজসেবক মামুন বিশ্বাস ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিতপ্রাণ আসাদুজ্জামান রুবেলকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘সহজকথন’-এর মোড়ক উন্মোচন। মো. আশিকুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত ম্যাগাজিনটিতে দেশের প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক ও কবিদের লেখা স্থান পেয়েছে।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সম্পাদক মো. আশিকুর রহমান বলেন, গ্রাম পর্যায়ের এই আয়োজনকে আমরা মেধা ও মননের জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছি। ‘সহজকথন’ ম্যাগাজিনটি সেই চেষ্টারই অংশ। এতে সমসাময়িক চিন্তা ও সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছি। গুণী লেখকদের লেখা এই সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। আশা করি পাঠকেরা এটি পছন্দ করবেন।
উৎসবের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল আতিউর রহমান নির্মিত ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা’-এর প্রদর্শনী। আতিফ আসাদের বই নিয়ে সংগ্রামের গল্প নিয়ে এটি নির্মিত হয়েছে।
নির্মাতা আতিউর রহমান বলেন, একজন তরুণ সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দিচ্ছেন— এই দৃশ্য আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। আতিফের এই লড়াইকে পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের গল্পগুলো মানুষের সামনে আসা জরুরি।
অনুষ্ঠানের সামগ্রিক আয়োজন নিয়ে সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘সুস্থ সমাজ গড়তে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিকল্প নেই। সহজপাঠ ফাউন্ডেশন তরুণদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক (সংস্থাপন) মো. আরজু পারভেজ বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে শিল্প ও সাহিত্যের এমন চর্চা আশাব্যঞ্জক। এটি জাতীয় সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করবে।’
সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আতিফ আসাদ বলেন, ‘এই উৎসব শুধু আনন্দ উদযাপনের জন্য নয়; হারানো ঐতিহ্য ও বইয়ের সঙ্গে মানুষের সখ্যতা গড়ে তোলার একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা চাই প্রতিটি গ্রামে একটি করে পাঠাগার গড়ে উঠুক। আজকের সফল আয়োজন আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন সাহস জোগাচ্ছে।’
২০১৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তরুণ আতিফ আসাদ মাত্র ২০টি বই নিয়ে ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’-এর মাধ্যমে এই উদ্যোগের সূচনা করেন। শুরুতে তিনি নিজেই সাইকেল চালিয়ে পাঠকদের হাতে হাতে বই পৌঁছে দিতেন। বর্তমানে বইয়ের সংগ্রহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আট হাজারে।
আতিফ আসাদ ইতোমধ্যে জামালপুরের সরিষাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় ১৮টিরও বেশি পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। বই পাঠ কার্যক্রমের পাশাপাশি এই উদ্যোগ এখন শীতবস্ত্র বিতরণ, বন্যাদুর্গতদের সহায়তা, বৃক্ষরোপণ ও কুইজ প্রতিযোগিতাসহ নানা মানবিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিস্তৃত হয়েছে। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগই আজ ‘সহজপাঠ ফাউন্ডেশন’ নামে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
আতিফ আসাদ/এমবি

