ছবি : বাংলাদেশের খবর
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক নেমে এসেছে তার শ্বশুরবাড়ি বগুড়ায়। দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে অলিগলি, চায়ের দোকান এমনকি পুরনো ভোটকেন্দ্রগুলোতেও বিরাজ করছে ভারী নীরবতা। কোথাও কোনো স্লোগান বা রাজনৈতিক উত্তেজনা নেই— কেবল স্মৃতিচারণা আর দীর্ঘশ্বাস।
যে শহর বারবার ভোটের মাধ্যমে তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, সেই বগুড়াই আজ হারালো নিজের বধূ, নেত্রী ও ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে।
খালেদা জিয়ার শ্বশুরবাড়ি বগুড়া হওয়া কেবল আনুষ্ঠানিক পরিচয় ছিল না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ নেয় আবেগের গভীর বন্ধনে। বগুড়ার মানুষ তাকে দেখেছে ঘরের বধূ হিসেবে, আবার দেখেছে দেশের নেতৃত্বে দৃঢ়চেতা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। বগুড়া-৬ (সদর) ও বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসন থেকে একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি রেকর্ড ভোটে জয়ী হন। প্রতিবারই তার বিজয়ের ব্যবধান ছিল চোখে পড়ার মতো।
শহরের প্রবীণ ভোটার আলী হোসেন বলেন, ‘ভোট দিতে গেলে মনে হতো নিজের মানুষকেই ভোট দিচ্ছি। তিনি আমাদের শহরকে কখনো ভুলে যাননি।’
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর খালেদা জিয়া ছিলেন নিভৃতচারী গৃহবধূ। রাজনীতিতে তখন তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। কিন্তু স্বামী হারানোর শোকের মধ্যেই তাকে নিতে হয় একটি ভঙ্গুর দলের দায়িত্ব। সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে টানা আন্দোলন, রাজপথের সংগ্রাম ও দলীয় ঐক্য বজায় রাখার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি পরিণত হন আপসহীন নেত্রীতে।
১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং মুসলিম বিশ্বেরও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলায় বগুড়া ছিল তার নির্ভরতার জায়গা।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে বগুড়ায় বিএনপির সব কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কালো পতাকা উত্তোলন, কোরআনখানি ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের মতে, এটি শুধু একজন নেত্রীর বিদায় নয়, একটি যুগের অবসান।
শোক কেবল দলীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন, এমন অনেক মানুষও এই মৃত্যুতে আবেগাপ্লুত। চায়ের দোকানি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনীতি বুঝি না। কিন্তু তিনি তো ইতিহাস। এই শহর থেকে উঠে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া গর্বের বিষয়।’
অনেকে স্মরণ করছেন সেই নির্বাচনী দিনগুলোর কথা—মিছিল, সভা, মানুষের ঢল। খালেদা জিয়া যখন বগুড়ায় আসতেন, রাস্তার দুই ধারে মানুষ জমায়েত হতেন তাকে এক ঝলক দেখার জন্য।
স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, ‘অনেক নেতাকে দেখেছি। কিন্তু খালেদা জিয়ার সফরে মানুষের আগ্রহ ছিল আলাদা। সেটা শুধু দলীয় আনুগত্য নয়, ব্যক্তিগত টানও ছিল।’
রাজনৈতিক জীবনে বিতর্ক, সংঘাত ও মামলা সবই তার জীবনের অংশ ছিল। ক্ষমতায় থাকা ও না থাকা—উভয় সময়ই তাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। কারাবরণ ও অবরুদ্ধ জীবনেও তিনি মাথা নত করেননি। বগুড়ার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সেই নারী, যিনি সব প্রতিকূলতার মধ্যেও আপসহীন থেকেছেন এবং এই শহরের নামকে জাতীয় রাজনীতির মানচিত্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
মঙ্গলবার সকালে জেলা বিএনপির কার্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় নেতাকর্মীদের কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন।
জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কেবল আমাদের নেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন মায়ের মতো। বগুড়ার মানুষের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক। তাঁর মৃত্যুতে আমরা সত্যিই এতিম হয়ে গেলাম। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তার আপসহীন নেতৃত্ব ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘ম্যাডাম অসুস্থ অবস্থাতেও দল ও দেশের মানুষের খোঁজ নিতেন। উন্নত চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই তাঁকে চলে যেতে হলো। এই অপূরণীয় ক্ষতি কোনোদিন পূরণ হবে না।’
সকাল থেকেই শহরের নওয়াববাড়ি রোডে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের ভিড় জমতে থাকে। জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় বগুড়া শহরের বায়তুর রহমান সেন্ট্রাল মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হয়েছে।
জুয়েল হাসান/এআরএস

