Logo

সারাদেশ

কুপিয়ে হত্যা: একমাত্র উপার্জনক্ষমকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবার

Icon

আলফাডাঙ্গা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৫৮

কুপিয়ে হত্যা: একমাত্র উপার্জনক্ষমকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবার
গ্রামটির সড়কগুলোতে যেন স্তব্ধ নিরবতা চলছে। একটু সামনে এগুতেই দৃষ্টি পড়ে গেল অনেক নারী-পুরুষ ও বাচ্চা ছেলে-মেয়ে একটি বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই যেন কান্নার আহাজারি ভেসে আসলো কানে।

সামনে দৃষ্টি মেলতেই দেখা মিললো সন্তানহারা বৃদ্ধা বাবার কান্নার আহাজারি। ঘরের মধ্যে নিহতের সন্তান, স্ত্রী ও স্বজনদের কান্নার সুরে আকাশ বাতাস যেন অনেকটা ভারি হয়ে উঠেছে বাড়ির আশপাশের পরিবেশ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ফাতেমা বেগম। কৃষক সাইফুল সর্দারের মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারছেন না। তাদের আহাজারিতে গ্রামজুড়ে বইছে শোকের মাতম।

মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সরেজমিনে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ জাটিগ্রাম এলাকায় গিয়ে এমনই করুণ দৃশ্য চোখে পড়ে।

গ্রাম্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাতের আঁধারে প্রতিপক্ষের অতর্কিত হামলায় খুন হয়েছেন সাইফুল সর্দার। এ ঘটনায় ওই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ।

কৃষক সাইফুল সর্দার উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ জাটিগ্রাম এলাকার হবি সর্দারের ছেলে। তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। বৃদ্ধ বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার তার।

বাড়ির বারান্দায় বসে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা হবি সর্দার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, 'আমার দুই ছেলে। দুই বছর আগে বড় ছেলেটা মারা গেল। পাঁচ মাস আগে ওদের মা-ও চলে গেল। এখন আমার ছোট ছেলেকেও খুনিরা কুপিয়ে মেরে ফেলল। একজন পিতার জন্য সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়া যে কত বড় কষ্টের, তা বুঝানোর ভাষা আমার নাই। আমি বৃদ্ধ মানুষ, আমার তো যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু মরার আগে আল্লাহ যেন আমার চোখের সামনে ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখে যাওয়ার তৌফিক দেন।'

নিহত সাইফুল সর্দারের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, 'আমরা রাতে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ পরিচয়ে ঘরে ঢুকে প্রতিপক্ষের লোকজন আমার স্বামীকে চোখের সামনে কুপিয়ে হত্যা করল। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমার স্বামী। আমার সব শেষ হয়ে গেল। সন্তানদের নিয়ে এখন আমি কীভাবে সংসার চালাব, কার কাছে দাঁড়াব?'

এসময় কথা হয় নিহত সাইফুল সর্দারের ১৩ বছর বয়সি মেয়ে ইলমা খানমের সঙ্গে। অশ্রুভেজা চোখে ইলমা খানম বলেন, 'চোখের সামনে আমার বাবাকে খুনিরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমি খুনিদের পায়ে ধরে বারবার বলেছি, আমার বাবাকে আর মারবেন না, ওনারে ছেড়ে দেন। তবুও ওরা আমার কথা শুনল না। পাষাণগুলোর মন একটুও গলল না। আমাদের চোখের সামনেই বাবাকে শেষ করে দিল। আমরা এখন এতিম হয়ে গেলাম। যারা আমার বাবাকে কুপিয়ে মারছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই।'

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) ভোররাত ৩টার দিকে উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ জাটিগ্রামের নিজ বাড়িতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাইফুল সর্দার। গ্রাম্য বিরোধের জের ধরে ‘শুটার জুয়েল’ নামে পরিচিত ওই এলাকার জুয়েল মিয়ার নেতৃত্বে সবুজ মিয়া, হাসিব মিয়া, সৈয়দ রাজিব আলী, আইয়ুব মিয়া, নুরু মিয়া, শুভ মিয়া, শাহা সুলতান প্রিন্সসহ একদল সশস্ত্র লোক গভীর রাতে এলাকায় তাণ্ডব চালায়।

তারা নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে প্রথমে সাইফুল সর্দারের ঘরে প্রবেশ করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। পরে পার্শ্ববর্তী ইসমাইল মোল্যার বাড়িতে গিয়ে তাকেও কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। হামলার পর আসামিরা এলাকার অন্তত ৭-৮টি বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে পালিয়ে যায়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সাইফুল সর্দারকে গোপালগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।

বর্তমানে গুরুতর আহত ইসমাইল মোল্যা ফরিদপুর মেডিক্যাল হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।

ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকালে সাইফুল সর্দারের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। ওইদিনই বিকাল ৫টায় ব্রাহ্মণ জাটিগ্রাম ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে ওই এলাকার সামাজিক কবরস্থানে সাইফুল সর্দারের দাফন সম্পন্ন করা হয়।এদিকে একটু সমবেদনা জানাতে নিহত সাইফুল সর্দারের বাড়িতে আসছেন আশেপাশের কয়েক গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ। কারও মুখে এই শোকের সান্ত্বনা দেওয়ার মত ভাষা জানা নেই।

স্থানীয়রা জানান, এ পরিবারটি ছিল অনেক অভাব অনটনে ভরপুর। তবে বাহিরের কারও নিকট কখনও হাত পাততে চোখে পড়েনি। এমন পরিবারের বিপদ দেখে আমরাই হতাশ হয়ে গেছি। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সৈয়দ শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে গ্রামে দলাদলি চলছে। কিন্তু তার জন্য একজন ঘুমন্ত মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করতে হবে কেন? ওর পরিবারের কী হবে এখন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সকল অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’

আলফাডাঙ্গা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসনাত খান জানান, 'হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ১০-১৫ জনের নামে আলফাডাঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ইতোমধ্যে এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাকী আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে।'

মিয়া রাকিবুল/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

হত্যা / খুন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর