জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি-ট্রেজারার-প্রকৌশলীর শত কোটি টাকার টেন্ডার জালিয়াতি
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ১৭:৪৯
-6835a6dbb534c.jpg)
(বাম থেকে) প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ, ড. এ টি এম জাফরুল আজম ও মো. মিজানুর রহমান
বৈষম্যহীন দেশ গড়ার স্বপ্নে ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। এ ঘটনার বছর না পেরোতেই ভয়াবহ বৈষম্যের মাধ্যমে শত কোটি টাকার টেন্ডার জালিয়াতিতে জড়ালেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ, ট্রেজারার ড. এ টি এম জাফরুল আজম ও প্রধান প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান। তাদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অনুসন্ধান চালিয়েছে সরকারের প্রতিযোগিতা কমিশন। সেই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে হতাশা জাগানো এই জালিয়াতির তথ্য।
অনুসন্ধান প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের খবরের হাতে এসেছে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টেন্ডারে অংশ নেওয়া পছন্দের দুটি প্রতিষ্ঠানকে অভিনব কৌশলে বিশেষ সুবিধা দিয়ে অন্যদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে। টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে পছন্দের ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে ১০৮ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার কার্যাদেশ পাইয়ে দিয়েছেন উপাচার্য ও তার দুই সহযোগী।
প্রতিযোগিতা কমিশন সূত্র বলছে, ২০২৫ সালের জন্য পরীক্ষার খাতা, অতিরিক্ত কাগজ, ওএমআর শিট (উত্তরপত্র) এবং সেলাই ও বাঁধাই করে এসব উত্তরপত্র রাখার ব্যবস্থার জন্য টেন্ডার আহ্বান করেছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। টেন্ডারটি যেন পছন্দের প্রতিষ্ঠান পায়, সেজন্য ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ করেন উপাচার্য আমানুল্লাহ, ট্রেজারার জাফরুল আজম ও প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান। এ জন্য তারা এই ‘টেন্ডার টেন্ডার খেলায়’ এমন নিয়ম বেঁধে দেন যাতে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর কেউ দৌড়ে পেরে না ওঠে।
প্রতিযোগিতা কমিশনের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, টেন্ডার দৌড়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে রাখতে লঙ্ঘন করা হয়েছে ‘প্রতিযোগিতা আইনের’ একাধিক উপধারা। দেওয়া হয়েছে বিশেষ সুবিধা। আইনের তোয়াক্কা না করে দর প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ‘টেন্ডার গেমে’ পছন্দের প্রতিষ্ঠানের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করা হয়েছে। বৈষম্যের এই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেড বাগিয়ে নিয়েছে ৫৪ কোটি ৩৪ লাখ ২ হাজার ৫০০ টাকার কাজ। আর প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং লিমিটেড বাগিয়েছে ৫৪ কোটি ২৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকার কার্যাদেশ।
সরকারের জারিকৃত পরিপত্র অনুসারে, কোনো সংস্থা নিজের টাকায় পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান সর্বোচ্চ ৩০ কোটি টাকার ক্রয়চুক্তি অনুমোদনের ক্ষমতা রাখেন। মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্রয়চুক্তি অনুমোদন করতে পারে। আর অনুন্নয়ন বাজেটের ক্ষেত্রে ৫০ কোটির বেশি টাকার ক্রয়চুক্তি অনুমোদন দেবেন ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’।
এই টেন্ডারের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির ক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাশ কাটিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেছে। সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে দাপ্তরিক প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়েছে এবং সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন ছাড়াই দরপত্রের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে- বলছে, প্রতিযোগিতা কমিশনের প্রতিবেদন।
বিশেষ ঠিকাদারদের সুবিধা দিতে এই দরপত্রের ক্ষেত্রে অবৈধভাবে ‘এক ধাপ দুই খাম’ (দুই পর্যায় বিশিষ্ট দরপত্র) পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। এখাই শেষ নয়, এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও এর শর্ত ব্যবহার করা হয়নি। প্রতিযোগিতার পথ রুদ্ধ করতে ব্যবহার করা হয়েছে মনগড়া কিছু শর্ত। দরপত্র সংগ্রহ করতে এমন কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে, যাতে পছন্দের ঠিকাদারই কেবল আবেদনের যোগ্য বিবেচিত হয়। এছাড়া পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা লঙ্ঘন করে দাপ্তরিক প্রাক্কলন করা হয়েছে এবং লট নির্ধারণেও বিধিমালা প্রতিপালিত হয়নি বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
আইন বলছে, একই কাজে কন্ট্রাক্টর বা সাব কন্ট্রাক্টর বা ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রাক্টর হিসেবে ৩ বা ৫ বা ১০ বছরে একটি কাজের অভিজ্ঞতার শর্ত নির্ধারিত রয়েছে। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ টেন্ডার অংশগ্রহণকারীদের একই কাজের জন্য সবশেষ ৩ বছরে কমপক্ষে ৪০ কোটি টাকা মূল্যের দুটি চুক্তি সফলভাবে সম্পন্নের শর্ত উল্লেখ করে, যা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত।
টেন্ডার জালিয়াতির বিষয়ে জানতে উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহকে গত তিনদিন কয়েক দফায় ফোন করা হয়েছে। এছাড়া তাকে মোবাইল ফোনে মেসেজ করা হয়েছে। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি, ক্ষুদে বার্তারও কোনো জবাব দেননি।
টেন্ডার জালিয়াতির আরেক হোতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান অনুসন্ধান টিমকে বলেন, ইজিপি সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এখানে কোনো অস্বচ্ছতার বিষয় নেই।
প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) তোফায়েল আহমেদ খান বলেছেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও ইজিপি সিস্টেমের মাধ্যমে টেন্ডার সম্পর্কে জেনেছিলাম। পরে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে একটি লটে এনওএ (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) পাই।
মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেডের পরিচালক (বিপণন ও প্রশাসন) শেখ ইমরান হোসেন বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে উন্মুক্ত দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছিলাম। দ্বিতীয় লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে আমরা চুক্তি সম্পাদন করি।
উপাচার্য, ট্রেজারার ও প্রধান প্রকৌশলীর দরপত্র জালিয়াতি নিয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) নুরন আখতার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারে এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনএমএম/এইচকে/এমএইচএস