Logo

অপরাধ

জেল থেকে ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’ চালাতেন সুব্রত বাইন

নুর মোহাম্মদ মিঠু

নুর মোহাম্মদ মিঠু

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ২২:০৩

জেল থেকে ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’ চালাতেন সুব্রত বাইন

ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। ছবি : সংগৃহীত

সুব্রত বাইন একসময় দেশের মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিল শুধু তার সহিংসতা বা খুনের জন্য নয়, বরং একটি সুসংগঠিত অপরাধ ব্যবস্থার মুখ্য কারিগর হয়ে ওঠার কারণে। সে হয়ে উঠেছিল একাধারে ‘ক্রাইম ব্র্যান্ড’ যার নাম শুনলেই একসময় আতঙ্ক হয়ে পড়তেন ঢাকার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদরাও। 

ছায়া-শাসন, নির্মমতা, আর রাজনৈতিক দলের মদদে শুধু সন্ত্রাসীই নয় কেবল রাষ্ট্রের জন্যও হয়ে উঠেছিল বড় বাধা। এমন চ্যালেঞ্জ ও আতঙ্কের ৬টি সুনির্দিষ্ট কারণও রয়েছে।

সুব্রত বাইনের পরিবার
সুব্রত বাইনের পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। জন্ম ১৯৬৭ সালে, ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জোবারপাড় গ্রামের সন্তান সুব্রত বাইন। মা ও তিন বোনকে নিয়ে মগবাজারে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। সুব্রত ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান।

নৃশংসতা ও প্রকাশ্যে সহিংসতা উল্লেখযোগ্য 
সুব্রতের গ্যাং প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে খুন করত। চাঁদা না দিলে তাকে গুলি করে হত্যা করত। গুলিস্তান, ফার্মগেট, তেজগাঁও, মগবাজার এলাকাগুলোতে “সুব্রতের লোকজন” থাকলে এড়িয়ে যেত পুলিশও।

চতুর অপরাধ প্রকৃতি 
অস্ত্র চালাতে বেশ পটু ছিলেন সুব্রত। এরচেয়েও ভয়ংকর বিষয় ছিল, অপরাধ সংঘটনে পূর্ব পরিকল্পনা ছিল সবার ভাবনারও উর্দ্ধে। কীভাবে আইনের ফাঁক দিয়ে পালাতে হয়, কোথায় যোগাযোগ করতে হয়, কার মাধ্যমে টাকা তুলতে হয়, এসবে ছিল তুখোড়। এমনকি জেল থেকেও সিন্ডিকেট পরিচালনা করত সে। যা তাকে অন্যদের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর ও বিপজ্জনক করে তোলে। 

অদৃশ্য উপস্থিতিতেও ছিল তার দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ 
তার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার লোকজন জানতো সে ভারত বা নেপালে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কখনো বা দেশ দুটির জেলে রয়েছে তবুও তার নামের ওপরই ঢাকায় আদায় হতো চাঁদা, হতো খুন, আসতো হুমকিও। এক ধরনের ভয়ংকর ছায়া-শাসন চালাতো সুব্রত বাইন। যার অস্তিত্ব বাস্তবে ছিল না, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ ছিল বাস্তব।

সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের নেতা ‘সেভেন স্টার’ 
তার ছিল সাত সদস্যের গ্যাং। যাদের প্রত্যেকেই ছিল প্রশিক্ষিত, ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর। সুব্রতের আদেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ঠিকাদার টার্গেট ব্যক্তিদের কেউই তার সেভেন স্টার গ্রুপের সদস্যদের হাত থেকে রেহাই পেত না। গ্যাংয়ের সদস্যরা বেতনভুক্ত ছিল না, তারা লুটের উপর চলত। যে কারণে সর্বদাই বেপরোয়া থাকতো গ্রুপের প্রতিটি সদস্য।  

রাজনৈতিক সংযোগে অপরাধ করেও রক্ষা 
সুব্রত রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের ছায়াতলেই কাজ করত। তাকে অনেক সময় মদদ দেওয়া হতো, প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য। যে কারণে অনেক পুলিশ অফিসারও নাগালের মধ্যে পেয়েও তাকে স্পর্শ করত না।

আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের যোগ 
ভারতের ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ গ্যাংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো সুব্রত বাইন। ভারতের কলকাতায় গিয়ে যে কারণে অস্ত্রের মজুতসহ পেয়ে যান নানা সুবিধা। পুলিশি তৎপরতার মুখে নেপালে গিয়েও নাগরিকত্ব নিয়েছিল অন্য নামে। যা তার পরিণত অপরাধী মনোভাবের প্রমাণ বলছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

দেশের চার শহরে ছিল নিয়ন্ত্রণ 
সুব্রত বাইন দেশজুড়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটাতে না পারলেও দেশের বড় বড় চারটি শহরে গেঁড়েছিলেন অপরাধের খুঁটি। এরমধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম। ঢাকার মগবাজারে করতেন গ্যাং ঘাঁটি, চাঁদাবাজি, খুন অস্ত্রের সঞ্চয়। ফার্মগেট থেকে করতেন টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক যোগাযোগ। গুলিস্তানে চাঁদার জন্য খুন ও দখলবাজি। তেজগাঁওয়ে সিন্ডিকেট পরিচালনা ও মোবাইল ফোনে হুমকি। উত্তরা বনানী এলাকায় উচ্চ প্রোফাইলধারীদের ব্যক্তিদের করা হতো টার্গেট, ঠিকাদারদের দেয়া হতো হত্যার হুমকি। নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায় চাঁদাবাজি ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ। গাজীপুরে শ্রমিক সংগঠনের ওপর প্রভাব ও চাঁদা আদায়। চট্টগ্রামে করতেন রাজনৈতিক সহিংসতার সমন্বয়। এছাড়াও চট্টগ্রাম ছিল তার প্রস্থানের অস্থায়ী পয়েন্ট।

আন্তর্জাতিক পলায়ন ও যোগাযোগে পারদর্শী সুব্রত বাইন
ধুরন্ধর ও দূরদর্শী শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন পালিয়ে ভারতে গিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করেন ভারতীয় অপরাধ চক্রের সদস্যদের সঙ্গে। কলকাতার কারায়, বউবাজার এলাকায় আত্মগোপন করলেও পলাতক অবস্থাতেই সেখানে করেন অস্ত্রের মজুত। যে কারণে ২০০৮-১২ সাল পর্যন্ত ভারতের জেলে বন্দিও ছিলেন। জামিন লাভ করলেও ফের গ্রেপ্তার হন। নেপালেও দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া পরিচয়ে বসবাস করেন সুব্রত। সেসময় আশরাফ আলী আনসারি নামে নাগরিকত্ব নেয়। নাগরিকত্বে জালিয়াতির কারণে তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত চাইলেও বাংলাদেশে তার প্রত্যর্পনে অস্বীকৃতি জানায় নেপাল।

ঢাকায় সুব্রত বাইনের এলাকাভিত্তিক অপরাধের ধরণ ও প্রভাব 
তার অপরাধকাণ্ডেও ছিল বিশেষত্ব। এলাকাভেদে পাল্টে যেত অপরাধের ধরণ। এরমধ্যে মগবাজারে করতেন চাঁদাবাজি, অস্ত্রের মজুত ও গ্যাং অপারেশন। এসবের মধ্যে দিয়ে মগবাজার এলাকায় ভয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় তার গ্রুপ। যার ফলে মগবাজার এলাকাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। যেখানে তার ভয়ে তটস্থ থাকতে হতো সাধারণ মানুষসহ অন্যদের, সেখানে অন্য কোনো শক্তিশালী সন্ত্রাসী গ্রুপও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। গুলিস্থানেও ছিল তার গ্রুপের দাপট। এই এলাকায় খুন, দখলদারি, চাঁদা আদায় আতঙ্ক ছিল তার গ্রুপের অন্যতম কাজ। এসবের মধ্যে দিয়ে গুলিস্থান এলাকারও দখল নিয়ে নেয় সুব্রত বাইনের গ্রুপ। তেজগাঁও এলাকায় করতেন গ্যাং ম্যানেজমেন্ট। আর সেখান থেকেই ব্যবসায়ীসহ টার্গেট ব্যক্তিদের ফোন করে দেওয়া হত হুমকি। দূরে থেকেও তেজগাঁও এলাকা ছিল তার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এরপর দেশ ছেড়ে পালানোর পর ভারতের কলকাতায় গিয়ে সংগ্রহ করতেন অস্ত্র, গ্যাংয়ে যোগ করতেন নতুন নতুন সদস্য। সেখানে থেকেই করেছিলেন আন্তর্জাতিক সংযোগ। কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। সেসময় আত্মগোপনের জন্য টার্গেট করেন নেপালকে। সেখানে নাগরিকত্ব জাল করে নাম নেন। পরবর্তীতে সেই অপরাধে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাগরিকত্বের জটিলতার কারণে বিচারের আওতায় আনতে পারেনি তাকে। দেশটিতে বিচারের ফাঁকি দিতেও সক্ষম হন সুব্রত বাইন।

সুব্রতের অপরাধ কেন্দ্র ও শাখা 
তার অপরাধের মূল কেন্দ্র ঢাকায় হলেও মূল ঘাটি ছিল মগবাজার। যেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার করতেন খুন-চাঁদাবাজিসহ বহু অপরাধ। এরমধ্যে ফার্মগেট, গুলিস্থান, তেজগাঁও, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও উত্তরা এলাকা ছিল তার অপরাধ রাজ্য। পরবর্তীতে তার অপরাধে জীবনে যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক মাত্রা। ভারত হয়ে নেপাল পর্যন্ত গড়ায় তার অপরাধ জীবন। লাভ করেন নাগরিকত্বও। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হতে হয়েছিল তাকে। নেপালের কারাগারেও কাটাতে হয়েছিল বন্দী জীবন। যে কারাগার থেকে ৬৭ ফুটের সুড়ঙ্গ কেটে পালিয়ে ভারতের কলকাতায় যান শীর্ষ এই সন্ত্রাসী।  

মাল্টি-জোন ক্রাইম সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড সুব্রত বাইন 
তার অপরাধের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ স্পট ছিল ঢাকায়। বিশেষ করে মগবাজার ঘিরেই তার অপরাধ জগতের ভিত্তি মজবুত হয়। তার গড়ে তোলা নিজস্ব বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে শুরুতেই গড়ে তুলতেন মানসিক দৃঢ়তা। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সদস্যদের গড়ে তুলতেন দৃঢ় মানসিকতায়। যে কারণে মজবুত চেইন অব কমান্ডের কারণে দূরে থেকেও যে নির্দেশ দিতেন গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর হতো মাঠে। এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে ঢাকায় যেখানে ঘটনা পর জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পারে তারা সুব্রত বাইনের গ্রুপের সদস্য এবং তার নির্দেশেই কাজ করে তারা। আন্তর্জাতিক সংযোগেও কোনো অংশে কম নেই সুব্রত। পালানোর পথে প্রতিটি ধাপেই রয়েছে তার সহায়তাকারী চক্র। গোপনীয়তা রক্ষায় ফটু সুব্রত বাইনের এমন চক্রের সন্ধানও আদৌ আজানা। চাঁদাবাজি থেকে খুন, সবই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।

এমআই

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর