
ছবি : এআই দিয়ে তৈরি
রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যে দেশে অপরাধের চিত্রও পাল্টেছে। পুরোনো অপরাধীদের জায়গা দখল করছে নতুনভাবে গড়ে ওঠা এক শ্রেণির দখলবাজ ও চাঁদাবাজ, যাদের বিরুদ্ধে আগে কোনো রেকর্ড ছিল না। তবে বর্তমানে তাদের নাম আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘টপ তালিকায়’ উঠছে। প্রশাসনিক রদবদল, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় দেশে গড়ে উঠছে এক ধরনের ‘অর্থনৈতিক সন্ত্রাস’, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশকে অনিরাপদ করে তুলেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ১৫ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানে ৬৫০ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭১ জনই নতুন অপরাধী, যাদের বিরুদ্ধে আগে কোনো দখল বা চাঁদাবাজির মামলা ছিল না। বর্তমানে তারা জমি দখল, বাজার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদা আদায়, হুমকি প্রদর্শন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ‘ম্যানেজ’ করার মতো অপরাধে সরাসরি যুক্ত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নবাগত অপরাধীরা শুধু অপরাধই করছে না, বরং নিজেদেরকে ‘ব্যবসায়ী’ বা ‘নেতা’ হিসেবেও পরিচয় দিচ্ছে। ঢাকার শিল্পাঞ্চল, চট্টগ্রাম বন্দর এবং খুলনার নদী-পাথরঘাট পর্যন্ত চাঁদা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষ করে খুলনা বিভাগের অবস্থা ভয়াবহ। সুন্দরবন, মোংলা বন্দর, মাছ ও বনজ সম্পদের দখল নিয়ে সেখানে নতুন দখলবাজদের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। খুলনায় গ্রেপ্তার হওয়া অপরাধীদের মধ্যে ৫৭% সম্পূর্ণ নতুন মুখ, যাদের বিরুদ্ধে আগে কোনো অপরাধের তথ্য ছিল না।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত বছরের আগস্টে চাঁদাবাজির প্রভাব কমে যাওয়ায় পণ্যমূল্য কমার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘তখন স্পষ্ট হয়েছিল যে চাঁদাবাজি না থাকলে মূল্যস্তরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই শূন্যতা, যা পূরণ না হলেই ভালো হতো, দ্রুত পূরণ হয়েছে। আগস্টের শেষ দিকে আমরা দেখেছি নতুন খেলোয়াড়রা এসে হাজির হয়েছেন এবং একই খেলা আবার শুরু হয়েছে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে গ্রেপ্তার ২৩৩ জনের মধ্যে ১৫০ জনই নতুন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৩ জনের মধ্যে ৩৭ জন নতুন, খুলনা বিভাগে গ্রেপ্তারদের ৫৭% নতুন অপরাধী। এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং দেশের দখল ও চাঁদার নতুন বাণিজ্যিক সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয়।
অপরাধের এই প্রসারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের ব্যবসায়ী। বহু উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, কেউ ব্যবসা বন্ধ বা বিনিয়োগ স্থগিত করছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে ‘রেড জোন’ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন। চাঁদাবাজির হুমকি শুধু ব্যবসা নয়, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়মিত চাঁদা চাপিয়ে দিলে শিল্পকারখানা উৎপাদন ব্যয় সামলাতে পারবে না, যা দেউলিয়া হওয়ার, শ্রমিক ছাঁটাই এবং অসন্তোষ তৈরি করার পথ খুলে দেয়।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘উৎপাদন খরচের চেয়ে যদি বিতরণের খরচটা অনেক বেশি হয়ে যায়, তাহলে তো স্পষ্ট যে এখানে অনেক ধরনের হাতবদল হচ্ছে পণ্যটা। ওই হাতবদলে প্রতিটা পর্যায়েই যোগ হচ্ছে চাঁদাবাজি। যদি চাঁদাবাজি যোগ করেন প্রত্যেকটা পর্যায়ে, তাইলে পণ্যের মূল্যের স্তর অনেক বেড়ে যায়।’
পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী সমন্বিত অভিযান চালাচ্ছে এবং অনেক জায়গায় সফলতা এসেছে। তবে পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম জানান, অভিযানের সময় প্রভাবশালী মহল থেকেও চাপ ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে থানা ঘেরাও, নেতাকর্মীদের মিছিল এবং রাজনৈতিক চাপ আসে। তিনি বলেন, ‘আমরা একা লড়তে পারি না, জনগণের সহযোগিতাও প্রয়োজন।’
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে নতুন ও পুরোনো সব অপরাধীর তথ্য রাখা যাবে এবং ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনের শাসন কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠা না করলে নতুন অপরাধীরা আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। তারা বলেন, আইন প্রয়োগে শিথিলতা মানেই দখলবাজদের উৎসাহ দেওয়া। রাজনৈতিক পরিচয় বা দলীয় রঙ ছাড়িয়ে যেকোনো অপরাধের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা মূল শর্ত হওয়া উচিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি, নৈতিক চর্চা ও গণতান্ত্রিক পরিচালন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে ঐতিহাসিক জুলাই আন্দোলনে শহীদ, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের এবং আপামর জনগণের হতাশা আরও বাড়বে।’
এনএমএম/এমএইচএস