লুটের অস্ত্রসহ অধরা ৭২৪ বন্দি, বাড়ছে নিরাপত্তা হুমকি
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৭:৪৭

প্রতীকী ছবি (এআই দিয়ে তৈরি)
দেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন নিরাপত্তা ভাঙনে গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশের ৫টি কারাগার থেকে পালিয়ে যায় ২ হাজার ২৪৪ জন বন্দি। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চমাত্রার নিরাপত্তায় থাকা জঙ্গি, বিডিআর বিদ্রোহ মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার অভিযুক্ত এবং বহু আলোচিত সন্ত্রাসবাদ ও খুনের মামলার আসামিরা। কিন্তু পলায়নের এক বছর পার হলেও এসব আসামিদের মধ্যে ৭২৪ জন এখনো পলাতক। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নজরদারিতেও তারা অধরা।
কারা অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, পলায়নের ঘটনা ঘটেছিল নরসিংদী, শেরপুর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে। ওই পাঁচটি কারাগার থেকে মোট ২ হাজার ২৪৪ জন আসামি পালালেও এখন পর্যন্ত পুনরায় গ্রেপ্তার করা গেছে ৩৬৩ জনকে। এছাড়া স্বেচ্ছায় ফেরত এসেছেন ১৬০ জন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বড় ধাক্কা ও নিরাপত্তার শঙ্কা হলো— ৭২৪ জন আসামি এখনো রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণেই নেই।
কারা সূত্র জানায়, পলায়নের সময় নরসিংদী ও শেরপুর কারাগার থেকে লুট হয় ৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৯ হাজার ১৯০ রাউন্ড গুলি। এর মধ্যে এখনো ২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৭ হাজার ৪৭৮ রাউন্ড গুলির সন্ধান মেলেনি। এছাড়াও লুট হওয়া অন্যান্য অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৩৩টি চাইনিজ রাইফেল, বিডিএইচডির ৩৮টি অস্ত্র ও ২৩টি শটগান। এসব অস্ত্র এখন কার হাতে তা জানা নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তবে পুলিশের পৃথক বিশেষ অভিযান কিংবা যৌথ বাহিনীর অভিযানেও এখন পর্যন্ত এসব অস্ত্র উদ্ধারের খবর মেলেনি। যদিও প্রতিটি অভিযানেই কমবেশি দেশি-বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছেই।
অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অস্ত্রসম্ভার এখন দেশের যেকোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের হাতে পৌঁছে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে। যে কারণে জুলাই-আগস্টে সামগ্রিকভাবে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে গতকাল সোমবার পুরস্কারও ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
তিনি বলেন, ঘোষণা অনুযায়ী কেউ যদি একটি এলএমজির তথ্য দিতে পারেন তাকে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। কেউ যদি একটি চায়না রাইফেলের সন্ধান দিতে পারে এবং সেটি উদ্ধার হয় তাহলে তথ্যদাতা ১ লাখ টাকা পাবে। এসএমজির ক্ষেত্রে দেড় লাখ এবং প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য ৫০০ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে। কেউ যদি একটা গুলি এনে দেয় তাহলে সে ৫০০ টাকা পাবে। পিস্তলের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার, শটগানের তথ্য দিলে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এসব তথ্য যারা দেবে তাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হবে। আজ মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বাংলাদেশের খবরকে জানায়, পুলিশ, কারা কর্তৃপক্ষসহ সামগ্রিকভাবেই লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এখন পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সার্কুলার হবে। পুরস্কারের চূড়ান্ত ঘোষণা তখন দেওয়া হবে।
কারা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, আদালত যখন কোনো আসামিকে তলব করেন, তখন আমাদের খুঁজে জানতে হয়, সে আসামি এখনো কারাগারে আছে কিনা। কারণ আমাদের হাতে তাদের কোনো রেকর্ড নেই। বাংলাদেশের খবরকে সূত্রটি জানায়, পলায়নের সময় অনেক কারাগারে নথিপত্র পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। যে কারণে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের কোনো রেকর্ড নেই।
জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই কাজ করে যাচ্ছি। তবে যেহেতু আমাদের দায়িত্ব কারাগারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ, তাই পলাতক আসামি ধরতে সরাসরি মাঠে নামার এখতিয়ার আমাদের নেই। এই কাজে আমরা গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের ওপর নির্ভরশীল। তারা নিয়মিত কাজ করছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ইস্যুও রয়েছে, ফলে পলাতক আসামি ও লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারের কাজ কিছুটা ধীর গতিতে চলছে।
তিনি জানান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘোষিত অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার প্রক্রিয়াও এই প্রচেষ্টার অংশ। প্রক্রিয়াগুলো চলমান। প্রতিটি জেলা প্রশাসকের মাসিক সমন্বয় সভায়ও আমরা বিষয়গুলো তুলছি। পলাতকদের দেয়া ঠিকানাগুলোতেও নজরদারি চালানো হচ্ছে। যদিও বাস্তবে দেখা যায়, পলাতকরা খুব কমই নিজ ঠিকানায় থাকে। তিনি আরও বলেন, আমাদের ২৯টিসহ যেসব অস্ত্রের তথ্য রয়েছে, সেগুলো ছাড়াও পুলিশের তালিকাও রয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ঘোষিত পুরস্কার এই দুই পক্ষের জন্যই প্রযোজ্য হবে।
পুলিশ ও আদালতের একাধিক সূত্র জানায়, নথি না থাকায় চার্জশিট দেয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে করে পলাতক আসামিরা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পুনরায় আত্মগোপনের সুবিধা পাচ্ছে।
এদিকে, পলায়নের সময় কারাগারগুলোর নিরাপত্তা ভেঙে পড়ায় ১৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে ৬ জন, জামালপুর কারাগারে ৭ জন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ জন ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রাণ হারান ১ জন। প্রাণহানির এসব ঘটনায় কারা অধিদপ্তর ৬টি মামলাও দায়ের করে। যদিও এসব মামলার তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া ধীরগতির ও অনিশ্চিত বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, পলাতক আসামিদের মধ্যে কেউ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের, কেউ জঙ্গি নেটওয়ার্কের অংশ। তারা আত্মগোপনে থেকে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। তাদের ধরতে টেকনোলজি ও গোয়েন্দা ইউনিট ব্যবহার করা হচ্ছে, যদিও সময় লাগছে।
তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসামিদের পলায়নের ঘটনায় শুধুই নিরাপত্তার শঙ্কাই নয়, বিচারপ্রক্রিয়ার ওপরও একটি বড় ধরনের আঘাত। বিচার বিলম্বিত হচ্ছে, মামলার চার্জশিটও অসম্পূর্ণ। অনেক মামলায় অভিযুক্তই নেই। এতে বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে।