ফেসবুকে তান্ত্রিক সেজে প্রতারণা
সন্তানকে ‘জ্বীনের মাধ্যমে বশ মানানোর’ টোপে নারী খোয়ালেন ৩৫ লাখ টাকা!
বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০:০০
পারিবারিক টানাপোড়েন, সন্তানের অবাধ্যতা, দাম্পত্য কলহসহ নানান কারণে মানসিক চাপে থাকা মানুষদের টার্গেট করেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে চলছে ‘আধ্যাত্মিক প্রতারণা’। গ্রাম থেকে শহর- সর্বত্রই গড়ে উঠছে এমন চক্র। তারা এখন আর গ্রাম্য তান্ত্রিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ফেসবুক লাইভ, রিল ও বিজ্ঞাপন প্রচার করে খুলে বসেছে প্রতারণার ফাঁদ। সম্প্রতি এমন একটি চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে একজন নারী মামলা করলে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর পুলিশের নিউমার্কেট বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর কবির এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেপ্তাররা হলো- রাকিব মাতব্বর, আলাউদ্দিন ব্যাপারী, মহিউদ্দিন ব্যাপারী, মানিক, ফরহাদ হোসেন ও মেহেদী হাসান।
এসি জাহাঙ্গীর কবির জানান, নিউমার্কেট এলাকার এক নারীকে ‘অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করা যাবে’— এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং পরবর্তীতে ভয় দেখিয়ে ৩৫ লাখ টাকারও বেশি হাতিয়ে নেওয়া তান্ত্রিক চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের সময় চক্রটির কাছ থেকে ১৩টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো ‘ফেক তান্ত্রিক পরিচয়’, ভয়েস চেঞ্জিং রেকর্ডিং এবং ভিকটিম ধরার জন্য পরিচালিত বিভিন্ন ফেসবুক পেজে ব্যবহার করা হতো।
এসি জাহাঙ্গীর কবির বলেন, গত ১৯ আগস্ট এলিফ্যান্ট রোডের ভাড়া বাসায় অবস্থানকালে ‘কোরআনিক শিফা’ নামের একটি ফেসবুক পেজে ‘অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করার উপায়’ শিরোনামের ভিডিও দেখতে পান। ভিডিওটিতে ধর্মীয় ছোঁয়া ও জ্বীনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেখতে পান তিনি। সব মিলিয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল অভিভাবকদের পক্ষে সেটিকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। ভুক্তভোগী নারীও তার ব্যতিক্রম নন। বিজ্ঞাপনে দেওয়া নম্বরে ফোন করেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু ‘তান্ত্রিক খেলা’।
ফোন রিসিভ করে এক যুবক নিজেকে ‘আধ্যাত্মিক গুরু’ পরিচয় দিয়ে জানায়, আপনার সন্তানের আচরণে জ্বীনের প্রভাব আছে। আমরা দোয়া-কালাম ও বিশেষ আধ্যাত্মিক পদ্ধতিতে তাকে বাধ্য করতে পারব। এ যেন এক অদৃশ্য ফাঁদ। যেখানে ভয়, দুর্বলতা ও সন্তানকে নিয়ে উদ্বেগ ব্যবহার করে প্রতারকরা ভুক্তভোগীকে একের পর এক আর্থিক ফাঁদে ফেলতে থাকে।
প্রথমে বলা হয়, কিছু ‘আধ্যাত্মিক উপকরণ’ লাগবে। ভুক্তভোগীর কাছ থেকে বিকাশে নেয় ৫ হাজার ৫০০ টাকা। পরদিন হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয় ‘কালো জাদুর’ সাজানো ছবি, ধূপ, আগুন, কালো পোশাক, রহস্যময় প্রতীক। যেন কাজ চলছে, এমন ভান তৈরি করতেই পুরো আয়োজন।
পর্যায়ক্রমে ‘ফোনে জ্বীনের কণ্ঠ’ও শোনানো হয়। ভয় দেখিয়ে বলা হয় আপনার সন্তান বড় বিপদে আছে। এরপর শুরু বড় অঙ্কের দাবি— ৪৯ হাজার টাকা, ১ লাখ টাকা; আবার নতুন ‘সমস্যা দেখা দিয়েছে’ বলে আরও টাকা লাগবে বলে জানায়।
তিনি বলেন, এভাবে ২১ আগস্ট থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার ১০৫ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। প্রতারকরা এতটাই পেশাদার ছিল যে ভিকটিমকে কখনোই সরাসরি দেখা করতে দেয়নি। সব যোগাযোগ হতো হোয়াটসঅ্যাপ, ভয়েস চেঞ্জার ও বিভিন্ন নম্বর থেকে।
অবশেষে ভিডিও, ভয়েস মেসেজ, নম্বর— সবই যখন অসংগত মনে হয়, তখন ওই নারীর মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটে। তিনি সরাসরি নিউমার্কেট থানায় যান। অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মামলার তদন্ত করেন নিউমার্কেট থানার এসআই মো. ফিরোজ আহম্মেদ। তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযানে নেমে প্রথম দিন বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হাজারীবাগের জিগাতলা ও রায়েরবাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ৫ জনকে। পরের দিন ভোরে যশোরের চৌগাছার যাত্রাপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরেক সদস্যকে।
তিনি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বিভিন্ন নামে ২৫টির বেশি ফেসবুক পেজ পরিচালনা করত বলে জানিয়েছে। যেগুলোতে ‘জ্বীন চিকিৎসা’, ‘কালো জাদু মুক্তি’, ‘স্বামী/স্ত্রী বশীভূত’, ‘সন্তান বাধ্য করার আমল’ ইত্যাদি ধরনের ভিডিও পোস্ট করা হতো। প্রতিমাসে তাদের টার্গেট ছিল অন্তত ৮-১০ জন ভিকটিম ধরার।
তিনি আরও বলেন, যেকোনো ধরনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসা, বশীকরণ, জাদু মুক্তি, জ্বীন তাড়ানোর নামে টাকা দাবি— এ সবই প্রতারণা।
এনএমএম/এমবি

