Logo

অর্থনীতি

আটকে আছে আইএমএফের ঋণের কিস্তি, নেপথ্যে প্রতিবেশী দেশ?

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৫, ০১:৪৭

আটকে আছে আইএমএফের ঋণের কিস্তি, নেপথ্যে প্রতিবেশী দেশ?

মাস ছয়েক আগেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের কথা থাকলেও সেটা পায়নি বাংলাদেশ। উল্টো নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে ঋণ বিতরণে সময়ক্ষেপণ করছে আইএমএফ। যদিও আওয়ামী লীগ আমলে খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংক খাত, রাজস্ব আদায়ে দুরবস্থা, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া ও মূল্যস্ফীত প্রায় ১২ ছুঁই ছুঁই পরিস্থিতিতে ঋণ দিয়েছিল দাতা সংস্থাটি। তখন নানাভাবে শর্ত শিথিলও করেছিল আইএমএফ।

অভিযোগ উঠেছে, এসবের পেছনে প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ কিছু কর্মকর্তা কলকাঠি নাড়ছেন। জানা গেছে, আইএমএফে থাকা ওই দেশের কিছু নাগরিক নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আছেন। বর্তমানে তারা বাংলাদেশবিরোধী সিদ্ধান্তগ্রহণে তৎপর। 

নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করে অন্যদের সহযোগিতা করেন- তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থায় এমনটি হওয়ার কথা নয়। তবুও বিভিন্ন কারণে অভিযোগের তীর আইএমএফে কর্মরত ওই দেশের কয়েকজন নাগরিকের দিকেই। 

জানা গেছে, আইএমএফের এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক অঞ্চলের পরিচালক ও বাংলাদেশের আইএমএফের আবাসিক প্রতিনিধিও একই দেশের নাগরিক।

আইএমএফ গত বছরের জুন পর্যন্ত তিন কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার ছাড় করলেও গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ পতনের পর আর কোনো কিস্তি বাংলাদেশকে দেয়নি। যদিও এ সময় দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসার পরিমাণে নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে চলতি মে মাসেও। এখন মূল্যস্ফীতি খুব না কমলেও বাড়েনি। পাশাপাশি ডলারের দর ১২০ থেকে ১২২ টাকার মধ্যেই স্থির রয়েছে।

গত এপ্রিলে দীর্ঘ দরকষাকষির পর ওয়াশিংটন বৈঠকে তিনটি শর্ত দেয় আইএমএফ। এরমধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, রাজস্ব আয় বাড়ানো ও ব্যাংক খাতের পুনরুদ্ধারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আইএমএফকে জানানো। ইতোমধ্যে রাজস্ব আয় ও ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। তবে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

এ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর বলছেন, এটি করা হলে সাধারণ মানুষের উপর চাপ বাড়বে। ফের অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে দেশের অর্থনীতি। কোনোভাবেই ডলারের দর বাজারে ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে না।

গত ২৯ এপ্রিল দেশে ফেরার পর সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘আইএমএফের দুই-একটা ইস্যু আছে, যেটা মেজর না। কিছু শর্ত আছে, যেগুলোর সব আমরা পরিপালন করতে চাই না। আমরা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক নির্ভরশীল না। সেই দিন চলে গেছে। আমাদের কর রাজস্ব আদায়ে আপাতত কোনো জটিলতা নেই, মুদ্রার বিনিময় হারে নমনীয়তা চায় আইএমএফ, যেখানে বাংলাদেশ কিছুটা ‘দোটানায়’ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সেসব বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আরগুমেন্ট (যুক্তিতর্ক) করেছি। তারা বলেছে, এই কর সেই কর -আমরা সে পথে হাঁটব না। বাংলাদেশের ম্যাক্রোইকোনমিকস অনেক ভালো। আইএমএফ থেকে টাকা পয়সা না নিয়ে ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট ও রিজার্ভ স্থিতিশীল আছে। এই সরকার আসার পর কিন্তু আমরা আইএমএফ থেকে কোনো টাকা পাইনি। তাদের বলেছি, তোমাদের টাকা ছাড়াই আমরা ম্যাক্রো ইকোনমিকস স্থিতিশীল করতে পেরেছি। তারা বলেছে, আমরা কন্টিনিউ করছি৷’ 

ড. সালেহউদ্দিন আরও বলেন, ‘আইএমএফের একটা বিষয় হলো বাজেট সাপোর্ট, সেটা আবার পাঁচ বছরের মধ্যে শোধ দিতে হয়। আর আইএমএফ টাকা দিলেই যে নেব এমন না-তো। আমরা তো ঋণের বোঝা নিতে চাই না। আমরা যদি ঋণ নিতে থাকি। আর এক্সচেঞ্জ রেট যদি কমে যায়। তাহলে তো ৩ বিলিয়ন দেওয়ার কথা থাকলে ৫ বিলিয়ন শোধ করতে হবে। আমরা সব কিছু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেব।’

আইএমএফের ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর বলেন, ‘আইএমএফের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার ঋণ আমাদের জন্য খুব জরুরি নয়। না পেলে দেশের অর্থনীতি থেমে যাবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে নিজস্ব আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করা। যেসব শর্ত গ্রহণযোগ্য, সেগুলোর ভিত্তিতেই আমরা ঋণ নিতে চাই। ঋণ ৬ মাস আগেও হয়ত দরকার ছিল, এখন সে পরিস্থিতি নেই।’

গভর্নর বলেন, ‘ডলারের দর এখন বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে প্রতি ডলারের দর হবে ১৫০ টাকা। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাবে। তখন আমার এই চেয়ারে থাকার কোনো অর্থ হয় না। প্রয়োজনে চেয়ার ছেড়ে দেব তবু আইএমএফের এমন অন্যায্য দাবি মেনে নেব না।’

পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও ওই দেশটি আইএমএফের ঋণ জব্দের চেষ্টা করে। গত ৯ মে আইএমএফের বোর্ড সভায় দেশটি দাবি করে, পাকিস্তানকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হলে তা ‘রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে’ ব্যবহার করা হতে পারে। তবে এমন দাবির জবাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আইএমএফের কর্মসূচি বানচালের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’ 

এখন আইএমএফ অজুহাত দাড় করিয়েছে, বাংলাদেশ চারটি ক্ষেত্র পিছিয়ে রয়েছে। সেগুলো হলো- রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি কম, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না হওয়া, ভর্তুকি না কমা ও ব্যাংক খাতের আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া। গত বছরের জুন পর্যন্ত আইএমএফ বাংলাদেশকে তিন কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার ছাড় করেছে। এরপর ডিসেম্বরে চতুর্থ কিস্তি ছাড় করার কথা থাকলেও তা দেয়নি। এখনো বাকি ২৩৯ কোটি ডলার কিস্তি ছাড় বাকি রয়েছে। ৫ আগস্ট ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এরপর থেকে দফায় দফায় ঢাকা ও যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনা চললেও কোনো ঋণ পায়নি বাংলাদেশ।

বর্তমান সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে। এখন ৯ শতাংশের ঘরে এসেছে। যা একটা সময় ছিল সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। আগামীতে আরও কমবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশাবাদী। কিন্তু এখন আইএমএফের শর্তে ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য ব্যর্থ হবে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতে রাজি হচ্ছে না।

আইএমএফের নির্দিষ্ট দেশের কোনো কর্মকর্তা বাংলাদেশের ঋণে প্রাপ্তিতের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছি কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘কেউ যদি মার্কিন নাগরিক হয়; তাহলে তিনি আমেরিকার কথা চিন্তা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে যারা চাকরি করেন তারা তো আর নাগরিকত্ব বিসর্জন দিয়ে চাকরি করেন না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নিজ দেশের স্বার্থের কথা ভাববেন এটাই স্বাভাবিক।’

এএইচএস/ওএফ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

জুলাই অভ্যুত্থান রেমিট্যান্স

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর