লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বিলুপ্ত এনবিআর, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৫, ০৯:৫৫
-682414357e259.jpg)
সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের রাজস্ব খাতে একটি বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে ধারাবাহিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
আর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নতুন দুটি বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে এমন সম্ভাবনা আছে।
তবে এই সংস্কারের সফলতা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। অর্থ উপদেষ্টা বলছেন, যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তারা আবার রাজস্ব সংগ্রহও করবেন, তা হতে পারে না। এনবিআর বিলুপ্ত হয়ে দুটি বিভাগ গঠিত হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলে প্রত্যাশা করছি।
স্বার্থের সংঘাত, দুর্বল প্রশাসন, রাজস্ব সংগ্রহে অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই এনবিআরের দীর্ঘদিনের সমস্যা। প্রায় ৫০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এনবিআর ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। তুলনামূলকভাবে, বৈশ্বিক গড় ১৬.৬ শতাংশ, আর মালয়েশিয়ায় ১১.৬ শতাংশ। দেশের জনগণের উন্নয়ন প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে বাংলাদেশের ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এ অবস্থায় সোমবার রাতে এনবিআরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার।
সংস্থাটি ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করেই বহুল আলোচিত ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ নামে নতুন যে বিভাগ গঠিত হবে, সেটির কাজ হবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব জোগানে সম্প্রসারণমূলক কর ভিত্তি, যৌক্তিক করহার, সীমিত কর অব্যাহতি নীতি অনুসরণ করে উত্তম কর ব্যবস্থা তৈরি করা। এ ছাড়া স্ট্যাম্প আইনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন নতুনভাবে প্রণয়ন বা সংশোধন করা, স্ট্যাম্প ডিউটি, আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, সারচার্জ ও অন্যান্য শুল্ক-কর, ফি আরোপ, হ্রাস-বৃদ্ধি ও অব্যাহতি প্রদান-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে এই বিভাগ।
পাশাপাশি কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতির মূল্যায়ন; কাস্টমস সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন ও মতামত প্রদান; আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম; রাজস্ব সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ ও গবেষণার মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের যথাযথ প্রক্ষেপণ ও প্রাক্কলন করা; রাজস্ব নীতি সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান, প্রজ্ঞাপন, এসআরও প্রণয়ন, সংশোধন ও ব্যাখ্যা প্রদান করবে এই বিভাগ।
এই বিভাগের জনবল সম্পর্কে বলা হয়েছে, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস, অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞদের দিয়ে বিভাগটির বিভিন্ন পদ পূরণ করা হবে। আর সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে বলে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে।
এ বিভাগকে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়ার জন্য অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, আইন বিশেষজ্ঞ, হিসাব ও নিরীক্ষা বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী সংগঠন, পেশাজীবী প্রতিনিধি, ট্যারিফ কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিত্বে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে অধ্যাদেশে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন নতুন এ বিভাগ গঠিত হবে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এ বিভাগের কাজের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ; কাস্টমস সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন; আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহারসংক্রান্ত চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন; কর ভিত্তি সম্প্রসারণে করসেবা, উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি জোরদার করা এবং সবাইকে করজালের মধ্যে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ; রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পদ্ধতি প্রণয়ন; রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রাজস্ব নীতি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন, দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলা এবং নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা। দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর এনবিআরের বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে। তবে এসব জনবল হতে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগেও পদায়ন করা যাবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালাক সেলিম রায়হান বলেন, এনবিআর ভেঙে দুটি নতুন বিভাগ-রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এই সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে এমন সম্ভাবনা আছে। ও নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম আলাদা করার সিদ্ধান্ত ভালো পদক্ষেপ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত উত্তম রীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
একটি বিভাগ নীতি প্রণয়ন ও আইন তৈরির কাজে যুক্ত থাকবে, অন্যটি আদায় ও বাস্তবায়নের কাজ করবে এভাবে দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতিশীলতা বাড়ানো সম্ভব। এই কাঠামো বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও ক্রমবর্ধমান রাজস্ব চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সহায়ক হতে পারে। তবে এই সংস্কারের সফলতা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক কর ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার দরকার। বাড়াতে হবে করের আওতা। করছাড় কমাতে ও পরোক্ষ করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে সরে আসার জন্য জোরালো প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত। প্রত্যক্ষ কর, বিশেষ করে আয়করের ভূমিকা বাড়াতে হবে। জনসংখ্যার ধনী অংশ, যারা সঠিকভাবে কর দেয় না, তাদের করের আওতায় আনতে হবে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম মনে করেন, বিলুপ্তির সিদ্ধান্তে এনবিআর কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ কমে যাওয়ার শঙ্কা আছে। এখন দুই বিভাগের যাঁরা সচিব হবেন, তাঁরা প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসতে পারেন, সেই পথ তৈরি হলো। এনবিআর থেকে সচিব হবেন কি না, তা বলা যায় না।
তিনি বলেন, তবে সরকার যদি মনে করে, দেশের স্বার্থে এই প্রতিষ্ঠান ভেঙে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, তারা সেটা করতে পারে। কিন্তু আমার কথা হলো, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল। কারণ, যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের আস্থায় নেওয়া সম্ভব না হলে এর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তাঁরা হতোদ্যম হয়ে পড়লে কাজ হবে না। সে জন্য আমি মনে করি, কর ও শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাঁদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন ছিল।
সবচেয়ে বড় কথা, রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা নামে যে দুটি বিভাগ করা হলো, তাদের সমন্বয় কীভাবে হবে। মূল উদ্দেশ্য তো রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি, সেটা আদৌ করা সম্ভব হবে কি না, অর্থাৎ করজাল বড় করা সম্ভব হবে কি না, তা বুঝতে পারছি না।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এনবিআর বিলুপ্তিতে কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সব দেশেই এমন আলাদা বিভাগ থাকে। এনবিআরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেই করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে এর প্রভাব পড়বে না। গতকাল মঙ্গলবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়বে না। এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় গত বারের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি হয়েছে। খুব হতাশাব্যঞ্জক নয়, আমরা আরও প্রত্যাশা করছি। অন্তত গত বারের তুলনায় কম হবে না। বিশ্বের সব দেশেই রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক। যাঁরা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাঁদের পেশাদার হতে হবে; অর্থাৎ দেশের জিডিপি, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান-এসব বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। যাঁরা নীতি প্রণয়ন করবেন তারা আবার বাজস্ব সংগ্রহও করবেন তা হতে পারে না।
সম্পর্কিত
পঠিত
মন্তব্য করুন