হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকিতে বাংলাদেশের জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা
প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৫, ১৬:০৫

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা নতুন মাত্রা নিচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব ক্রমেই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পরিণত হচ্ছে, যেখানে হামলা-পাল্টা হামলায় লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি ও সামরিক স্থাপনা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে এতে যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতি শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং বিশেষ করে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
হরমুজ প্রণালি:
বিশ্ব জ্বালানির স্পর্শকাতর শিরা : বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক জ্বালানি পরিবহন রুট হরমুজ প্রণালি। মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি প্রধান তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ-সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও ইরান—এই প্রণালি ব্যবহার করেই জ্বালানি পণ্য রপ্তানি করে থাকে। প্রতিদিন প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি এই পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়, যা সারা বিশ্বের সামুদ্রিক জ্বালানি বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশ।
হুমকির মুখে কাতার-বাংলাদেশ এলএনজি সরবরাহ : বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির নির্ভরযোগ্য উৎস কাতার। ২০১৭ সালে এবং ২০২৩ সালে কাতারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ বছরে কয়েক মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানি করে থাকে। তবে কাতার থেকে এনার্জি সরবরাহের একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি। যেহেতু এলএনজি স্থলপথে পরিবহন সম্ভব নয়, এই প্রণালি বন্ধ হলে বাংলাদেশের আমদানি কার্যক্রম পুরোপুরি থেমে যেতে পারে।
বিপিসি ও পেট্রোবাংলার শঙ্কা :
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, হরমুজ প্রণালির ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা অত্যন্ত গভীর। কাঁচা তেল ও পরিশোধিত পণ্যের একটি বড় অংশ এই পথ দিয়ে আসে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা রয়েছে, তা সৌদি আরব ও আমিরাত থেকেই আসে এবং এই দুই দেশের জ্বালানি পরিবহনও একই প্রণালির ওপর নির্ভরশীল।
যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হলে এবং ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে, সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়তে পারে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারিত হয় আন্তর্জাতিক বাজারের গড় মূল্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে এ ধরনের সংকট।
বিকল্প পথ ও সম্ভাবনার খোঁজে :
সরকার বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি আমদানির চেষ্টা করছে। বিপিসির একাধিক বেসরকারি প্ল্যান্ট অন্য দেশ থেকে সরবরাহ পেতে সক্ষম হলেও, এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে এখনো কোনো কার্যকর বিকল্প পথ গড়ে ওঠেনি। ফলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে এলএনজি আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। এটি শুধু শিল্প খাত নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনেও বড় ধরনের চাপ তৈরি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু ওই অঞ্চলের জন্য নয়—পৃথিবীর অনেক দেশের জন্যই বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মতো জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশের জন্য হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার বিকল্প চিন্তা করলেও বাস্তবিক প্রয়োগযোগ্যতা এবং প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি যদি আরও জটিল হয়, তাহলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও মূল্যস্ফীতির ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হতে পারে-যা দেশের অর্থনীতিকেও দুর্বল করে দিতে পারে।
এনএমএম/এমআই