মার্জার ‘সতীদাহ প্রথার আধুনিক রূপ’, অভিযোগ ব্যাংক পরিচালকদের
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৯:৪৬
-68692cb4f0b06.jpg)
কোলাজ : বাংলাদেশের খবর
বাংলাদেশের পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে একীভূতকরণ (মার্জার) প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে নেওয়া এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ব্যাংক খাতজুড়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) পরিচালকেরা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতেই এই মার্জার উদ্যোগ। তবে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যাংক পরিচালক একে ‘সতীদাহ প্রথার আধুনিক রূপ’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করছেন, কারণ তাদের মতে— কিছু ব্যাংক আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তাদের দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাবিত এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার আওতায় রয়েছে এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিম ও এসআইবিএল সম্প্রতি খেলাপি আদায় ও আমানত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দাবি করছে। তবে ফাস্ট সিকিউরিটি, গ্লোবাল ও ইউনিয়ন ব্যাংকের আর্থিক দুরাবস্থা এখনও কাটেনি।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। আমানত সংগ্রহ ও খেলাপি আদায়ে আমাদের অগ্রগতি আছে। অথচ আমাদেরকে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার করতে বলা হচ্ছে, যা কার্যত সক্ষম ব্যাংকের জন্য আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে।
তিনি দাবি করেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত এক্সিম ব্যাংকে ২ লাখ ৯৪ হাজারের বেশি নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে এবং ওই সময়ে ১০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা নতুন আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ডা. মো. রেজাউল হক বলেন, আমরা এখনো মার্জার বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপে যাচ্ছি না। তবে সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের বিকল্প কিছু থাকবে না। তখন হয়তো শেয়ার ছেড়ে দিতে হবে।
ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, এই ব্যাংকগুলো দেশের প্রায় ৩০০ থানায় অনুপস্থিত। তাদের ব্যবসায়িক কাঠামো শহরভিত্তিক এবং অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়ন্ত্রিত। ব্যাংক বন্ধ না করে একীভূত করার প্রস্তাব বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কোনো ব্যাংক মার্জার প্রক্রিয়া এড়াতে চাইলে তাদের নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ, বাধ্যতামূলক তারল্য অনুপাত (এসএলআর) ও নগদ জমা অনুপাত (সিআরআর) পূরণ এবং পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণ।
তবে যদি কোনো ব্যাংক নিজস্বভাবে টিকে থাকতে চায়, তাহলে স্পনসর ও পরিচালকদের নতুন মূলধন (ফ্রেশ ক্যাপিটাল) যোগানের বাধ্যবাধকতা থাকবে। এসব শর্ত পূরণ করতে না পারলে সেই ব্যাংককে মার্জারের আওতায় আনতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংককে অধিগ্রহণ, সম্পদ হস্তান্তর এবং ‘ব্রিজ ব্যাংক’ গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, রেজল্যুশনের সময় কোনো ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার শেয়ার বিক্রি করতে পারবেন না এবং সম্পদ হস্তান্তরের মূল্য নির্ধারিত হবে ওপেন বিডিংয়ের মাধ্যমে।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম. হেলাল আহমেদ বলেন, গত দেড় দশকে ব্যাংক খাত রাজনৈতিক প্রভাব, নিয়ন্ত্রণহীন ঋণ বিতরণ ও লুটপাটে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন, তা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১.২১ শতাংশ।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাত সংস্কার ছাড়া অর্থনীতি এগোবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান সংস্কার কার্যক্রম সময়োপযোগী এবং তা অব্যাহত রাখা উচিত।
বিগত সরকার আমলে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ এবং আর্থিক প্রতিবেদনে ‘সাজানো’ তথ্য দিয়ে ব্যাংকের অবস্থান ভালো দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা আস্থা হারিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে শুরু করলে অনেক ব্যাংক চরম তারল্য সংকটে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ব্যাংক মার্জার নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কোনো ব্যাংক মার্জার হলে কর্মীদের চাকরি যাবে না।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা, আর্থিক সক্ষমতা ও নতুন মূলধনের যোগান বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী দিনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে—কোন ব্যাংক মার্জারে থাকবে, কোনটি নয়।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিনের গলদ সংস্কারের পথে এই উদ্যোগ বড় এক মাইলফলক হতে পারে। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা না গেলে বিতর্ক ও অনাস্থা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এএইচএস/এমএইচএস