
ছবি : সংগৃহীত
এক সময় বাঙালিকে গর্বের সঙ্গে বলা হতো “মাছে-ভাতে বাঙালি”। কিন্তু বর্তমানে মাছ ও ভাত—এই দুইটি পণ্যই সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইলিশের রেকর্ড দামের মৌসুমে চালের বাজারেও লেগেছে আগুন। বাজারে এ দুই খাদ্যপণ্যের দামের এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে।
চালের বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মো. বাচ্চু জানান, “বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের সিন্ডিকেটের জন্যই চালের দাম বেড়েই চলেছে।” তিনি বলেন, নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের দাম তিন সপ্তাহে কেজিতে ৮-১০ টাকা, স্বর্ণা ও গুডি চালের দাম বেড়েছে ৪-৫ টাকা।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম মো. নাজের হোসাইন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, “বড় বড় গ্রুপ অব কোম্পানিগুলো কোনো কারণ ছাড়াই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় শুধু দেখছি দেখবো বলে সময় ক্ষেপণ করছে, কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
সরকারি মজুদ যথেষ্ট, তবু বাড়ছে দাম
খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জামাল হোসেন জানান, “বর্তমানে সরকারের কাছে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে।” তবে দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, “টানা বৃষ্টির কারণে মিলগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।”
তবে বাজারে চালের দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মিনিকেট নামে বাজারে থাকা চালের দাম ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে, যদিও বাস্তবে ‘মিনিকেট’ নামে কোনো চাল নেই।
ইলিশের দাম ছুঁয়েছে আকাশ
জাতীয় মাছ ইলিশ এখন যেন মধ্যবিত্তের পাতে স্বপ্ন। ঢাকার বাজারে ৫০০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২,২০০ টাকায়, এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম ২,৮০০ টাকা—যা দেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। ছোট আকারের ৪০০-৫০০ গ্রামের ইলিশও বিক্রি হচ্ছে ১,৬০০-১,৮০০ টাকায়।
ক্রেতা মোবারক হোসেন বলেন, “ইলিশের দাম ৩ হাজার টাকা চাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ২৮০০ টাকা দিয়ে একটা মাছ কিনলাম। এখন তো বাইলা-পুঠির মতো ছোট মাছও ৮০০ টাকা কেজি।”
আক্ষেপ জানিয়েছেন গৃহবধূ রূপা আক্তার, তিনি জানান, ইলিশ মাছ কিনতে গিয়ে হোচট খেয়েছি। বাজারে নিয়ে এসেছি ২০০০ টাকা এখন ৫০০ গ্রামের একটা ইলিশ মাছের দামেই ২০০০ টাকা তাহলে আমাদের মত পরিবারের একদিনের সমস্ত বাজারের টাকা একটি মাছ কিনতেই খরচ হয়ে যাবে। অন্যান্য বাজার আর কেনা হবে না। তাই পাঙ্গাস আর তেলাপিয়া কিনেছি।
একজন মাছ বিক্রেতা আফসোস করে জানান, ‘পরিবারের অনেকেরই ইলিশ মাছ খুবই পছন্দের। কিন্তু এত দামের কারণে কেনা সম্ভব না। দাম কমলে হয়তো পরে কিনব। তাছাড়া বাজারে অন্যান্য মাছের তুলনায় এখন ইলিশ মাছ খুবই কম। এ জন্য দামও অনেক বেশি।’
প্রাকৃতিক মাছের সংকট, চাষের মাছই ভরসা
মাছ বিক্রেতা মো. সবুজ আলী জানান, “নদী ও খাল-বিলে এখন মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। প্রাকৃতিক মাছের সংকট থাকলেও চাষের মাছের সরবরাহ ভালো, তাই দাম তুলনামূলক কম।” তবে বড় সাইজের ইলিশ রপ্তানি হয়ে যাওয়ায় দেশীয় বাজারে বড় ইলিশ মিলছে না। যা পাওয়া যাচ্ছে তাও চড়া দামের কারণে ক্রেতা কম।
দেশে বর্তমানে চাল ও মাছ—দুইয়ের বাজারেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। সরকার মজুদের তথ্য দিয়ে আশ্বস্ত করলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, “যে দেশে ১৫ লাখ টন চাল মজুদ থাকে, সেখানে কেজি প্রতি ১০-২০ টাকা দাম বাড়ার যৌক্তিকতা কোথায়?”
প্রশ্ন উঠছে, চাল-মাছের বাজারে কি তবে ‘অদৃশ্য হাত’ কাজ করছে? না হলে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’র জীবনে এমন অনিশ্চয়তা কেন?
সাধারণ মানুষ বলছেন, গত ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর ঘটিত এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এই সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। জুন ২০২৫ মাসের পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি হিসাব করে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের তুলনায় ২ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর তথ্য মতে, গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এসময় খাদ্য মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়ে ৭.৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও হ্রাস পেতে শুরু করেছে।”
গত ৭ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আশা প্রকাশ করেন ২০২৫ সালের শেষে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ এর নিচে নেমে আসবে। তার মতো আশাবাদ প্রকাশ করেন অর্থ উপদেষ্টা ড সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
এএইচএস/এএ