
গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও শেয়ার আত্মসাতের মাধ্যমে চার সিকিউরিটিজ কোম্পানির পকেটে যাওয়া প্রায় ২০০ কোটি টাকা তিন বছরেও উদ্ধার করতে পারেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ টাকা ফেরতের বিষয়ে ২০১৪ সালে ডিএসই ইনভেস্টরস প্রোটেকশন ফান্ড নামে একটি ফান্ড গঠন করা হয়। কিন্তু সেই ফান্ডও এখন প্রায় ফাঁকা। দায় এড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ডিএসই ফান্ড সংকটকে দুষছেন। তবে ডিএসইর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে ফান্ডে সিকিউরিটিজ কোম্পানিগুলোর টাকা জমা হবে। কিন্তু তাতেও আস্থা রাখতে পারছেন না ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা।
জানা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চারটি ব্রোকারেজ হাউজ— বানকো সিকিউরিটিজ, তামহা সিকিউরিটিজ, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ এবং শাহ মোহাম্মদ সগির অ্যান্ড কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাতের টাকা ফেরত দেয়নি। এসব সিকিউরিটিজ কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার দাবি রয়েছে, যা গত প্রায় তিন বছরেও পরিশোধ করতে পারেনি ডিএসই। এ জন্য ডিএসই পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের (বিএসইসি) কাছে একাধিকবার সময় চেয়েছে। তবে সুরক্ষা ফান্ডে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় সেই দাবি পূরণ করতে পারেনি।
সুরক্ষা ফান্ড গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়, পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউজগুলো গ্রাহক অ্যাকাউন্টে অর্জিত সুদের ৭৫ শতাংশ পাবে। বাকি ২৫ শতাংশ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা তহবিলে জমা দিতে হবে, যা বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হবে। ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গঠিত টাস্কফোর্সের সম্মতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তের লক্ষ্য হলো বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা বাড়ানো এবং সামগ্রিক নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে শক্তিশালী করা।
ডিএসইর তথ্য মতে, জুলাই মাস পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) চারটি ব্রোকারেজ হাউজ— তামহা সিকিউরিটিজ, বানকো সিকিউরিটিজ, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ এবং শাহ মোহাম্মদ সগির অ্যান্ড কোম্পানির কাছে বিনিয়োগকারীদের পাওনার পরিমাণ প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা।
এর মধ্যে বানকো সিকিউরিটিজের কাছে ৭৩.৬১ কোটি টাকা, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের কাছে ৩৩.৭২ কোটি টাকা, তামহা সিকিউরিটিজের ২৬.৮৬ কোটি এবং শাহ মোহাম্মদ সগির অ্যান্ড কোম্পানির কাছে ১১.৫৯ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের পাওনা রয়েছে।
তবে ডিএসইর হিসাবে চার ব্রোকারেজ হাউজের ৫০ হাজারের বেশি গ্রাহকের মোট ২১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকার নগদ জমা ঘাটতি রয়েছে। এর বাইরে ঘাটতি থাকা শেয়ারের মোট মূল্য ছিল ১৩০ কোটি টাকা। তবে ডিএসই’র কাছে ৮ হাজার ৬৮০ জন গ্রাহক তাদের পাওনা ২০৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা ফেরত চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন। এর মধ্যে ডিএসইর মাধ্যমে মাত্র ১৬ কোটি টাকা পরিশোধ হয়েছে। তবে তামহা সিকিউরিটিজের মালিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সমঝোতার মাধ্যমে কিছু টাকা বুঝে নিয়েছেন একজন প্রভাবশালী গ্রাহক। কিন্তু ফান্ড সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৪৫ কোটি টাকার বেশি। কবে নাগাদ এই টাকা ক্ষতিগ্রস্তরা পাবেন তার কোনো দিন-তারিখ কেউ বলতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের নেতা সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ডিএসই লোক দেখানো কমিটি করেছে। যার ফলে গত প্রায় তিন বছর পর হলেও তারা বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশের বেশি টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। আমরা বারবারই বলেছি, বিনিয়োগকারীদের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু বিএসইসি ও ডিএসই এ ব্যাপারে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। তারা মালিক পক্ষের সঙ্গে বসছে বারবার। কিন্তু মালিকপক্ষ সেই সময়ও বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে। এখন তারা বলছে, সম্পদ বিক্রি করে টাকা দেবে। এটা সময় ক্ষেপণ ছাড়া কিছুই নয়। আমরা দ্রুত বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
ডিএসইর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, চার ব্রোকারেজ হাউজের কাছে বিনিয়োগকারীরা প্রায় ১৫০ কোটি টাকা পাবে। কিন্তু ডিএসইর বিনিয়োগকারী সুরক্ষা ফান্ডে বর্তমানে মাত্র ১৯ কোটি টাকা আছে। যা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের পাওনা পরিশোধ করা অসম্ভব। যে কারণে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোর জুলাই ভিত্তিক অডিট রিপোর্টের দিকে। অডিট সম্পন্ন হলে সেখান থেকে কিছু ফান্ড হয়তো আসবে আশা করা যায়।
কবে নাগাদ বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাবেন জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা টাকা ফেরত পাবেন। প্রথমে বিনিয়োগকারীদের পাওনা দাবি ছিল ৩০০ কোটি টাকা। পরে দেখা যায়, একজন বিনিয়োগকারীই দুইবার করে আবেদন করেছেন। সেকারণে টাকার পরিমাণও বেশি দেখানো হয়েছিল।
তিনি জানান, সিকিউরিটিজ কোম্পানিগুলোর জুলাই ভিত্তিক অডিট সম্পন্ন হলে সুরক্ষা ফান্ডে টাকা জমা হবে। এরপর সেখান থেকে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত ডিএসই প্রায় ৩০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের ফেরত দিয়েছে। এর মধ্যে ছোট ছোট কিছু বিনিয়োগকারী তাদের পূর্ণ অর্থ ফেরত পেয়েছে। বড় কিছু বিনিয়োগকারী তাদের টাকা এখনো পুরোপুরি পায়নি। আবার কিছু বিনিয়োগকারী সরাসরি সিকিউরিটিজ কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে তাদের মধ্যেই বিষয়টি সমাধান করেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের হিসাবে এখন প্রায় ১১৫ কোটি টাকা পাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। এটা সাময়িকভাবে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে করা হয়েছে। শেয়ার ও অর্থ আত্মসাৎকারী সিকিউরিটিজ কোম্পানিগুলোকে ছাড় দেওয়া হবে না, তাদের সম্পদ থেকে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
শেয়ারজারের তালিকাভুক্ত ব্রোকারেজ হাউজের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা ডিএসইর সুরক্ষা তহবিল থেকে অর্থ পাবেন, সেগুলো হলো ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, বানকো সিকিউরিটিজ, তামহা সিকিউরিটিজ এবং শাহ সগির অ্যান্ড কোং। এসবের মালিকরা গ্রাহকদের অর্থ ও শেয়ার আত্মসাৎ করেছেন। এসব ব্রোকারেজ হাউজের গ্রাহকদের মধ্যে ২০২৩ সালে ১ অক্টোবরের মধ্যে পাওনা চেয়ে যারা আবেদন করেছেন, কেবল তাদের অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা বলেছে বিএসইসি।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা চার ব্রোকারেজ হাউজের কাছে ৫০ হাজারের বেশি গ্রাহক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করে মোট ২১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকার নগদ জমা ঘাটতি পায় ডিএসই। এর বাইরে ঘাটতি থাকা শেয়ারের মোট মূল্য ছিল ১৩০ কোটি টাকা। তবে মোট ৮ হাজার ৬৮০ গ্রাহক ২০৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা ফেরতের দাবি জানিয়ে ডিএসইতে আবেদন করে। এর মধ্যে ডিএসইর মাধ্যমে মাত্র ১৬ কোটি টাকা পরিশোধ হয়েছে। তবে তামহা সিকিউরিটিজের কিছু প্রভাবশালী গ্রাহক ব্রোকারেজ হাউজটির মালিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সমঝোতার মাধ্যমে কিছু টাকা বুঝে নিলেও দীর্ঘদিন ধরে ডিএসইর ফান্ড সংকটের কারণে আটকে আছে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৪৫ কোটি টাকার বেশি।
২০২৩ সালে সবশেষ বিএসইসির কাছে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার নিয়ে সময় আবেদন করেছিল ডিএসই। তবে বর্তমান এই তহবিলে বড় অঙ্কের দাবির বিপরীতে খুবই অপ্রতুল ফান্ড রয়েছে। ডিএসই জানিয়েছে, এই দাবির সঠিক মূল্যায়ন ও সম্পদের হিসাব শেষ হয়েছে। আগামীতে সুরক্ষা তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ডে দাবিগুলো উপস্থাপন করা হবে।
বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলের এমন দুর্বল অবস্থার কারণে জানতে চাইলে ডিএসই’র পরিচালক শাকিল রিজভী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আসলে সিকিউরিটিজ কোম্পানিগুলো থেকে এতদিন ফান্ড আসেনি, তাই ফান্ড কমে গিয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের ৩০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এখনো প্রায় ১১৫ কোটি টাকা বাকি আছে। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন ডিএসইর এই পরিচালক।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ডিএসই ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত না দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ডিএসইর কাছে জমা হওয়া আবেদনের প্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারী সুরক্ষা ফান্ড থেকে আনুপাতিক হারে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে বিনিয়োগকারী সুরক্ষা ফান্ডে পর্যাপ্ত টাকা নেই। ফান্ড আসলে টাকা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। ট্রেক, ব্রোকার এবং ফান্ড— সবই এক্সচেঞ্জের। এ ক্ষেত্রে কমিশন সব সময়ই ডিএসইকে আইনি সাপোর্ট দিয়ে যাবে।
এমএইচএস