Logo

অর্থনীতি

সাবেক ভূমিমন্ত্রীর লুটপাটে দুরবস্থা ইউসিবির

Icon

মেহেদী হাসান সজল

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০

আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৮:৪৫

  • ২০২৪ হিসাব বছর শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮,৫৩৪.৪০ কোটি টাকা
  • বছর শেষে ৩,৮৯৬.২৬ কোটি টাকা সঞ্চিতি গঠনে ব্যর্থ 
  • সঞ্চিতিসহ মোট ঘাটতি ৪.৮৬৯.১৩ কোটি টাকা
  • সঞ্চিতি গঠন না করে ৩.৮৮৮ কোটির লোকসানকে ৮ কোটি মুনাফায় রূপান্তর

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকিং খাতের কোম্পানি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) পিএলসি বড় পরিসরে খেলাপি ঋণের ভারে ধুঁকছে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যার বিপরীতে বড় অঙ্কে সঞ্চিতি গঠনের প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাংকটি নগদ অর্থের অভাবে সেই সঞ্চিতি গঠন করতে পারছে না। উল্টো ব্যবসা পরিচালনায় ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৯৭৩ কোটি টাকা। সঞ্চিতি ঘাটতি ধরে হিসাব করলে ব্যাংকের মোট ঘাটতি দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার বেশি। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা ঋণের নামে ব্যাংকটি থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুট করায় এই দুরবস্থায় পড়েছে ইউসিবি।

ব্যাংকটির নিরীক্ষক জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউসিবি মোট ৫৭ হাজার ২৮২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ঋণ ও অগ্রিম বাবদ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৫৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা শ্রেণিকৃত (মন্দ ঋণ) হিসেবে পরিণত হয়েছে। নিয়ম অনুসারে এই ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে ব্যাংকটিকে ৬ হাজার ৫৫ কোটি ১২ লাখ টাকা সঞ্চিতি গঠন করতে হতো। কিন্তু আলোচিত সময়ে ব্যাংকটি এর বিপরীতে মাত্র ২ হাজার ৭০৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা সঞ্চিতি গঠনে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে প্রয়োজনীয় ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা সঞ্চিতি গঠনে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি।

এদিকে ব্যাংকটি কয়েকটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) ১৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিল, যার মেয়াদ কয়েক বছর আগেই শেষ হলেও উত্তোলন সম্ভব হয়নি। এই অর্থ কখনো উত্তোলন করা সম্ভব হবে কী-না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। নিয়ম অনুসারে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আমানতের বিপরীতে সঞ্চিতি গঠন করতে হয়। কিন্তু ইউসিবি কর্তৃপক্ষ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বিপরীতে কোনো ধরনের সঞ্চিতি গঠন করেনি। এর বাইরেও ব্যাংকটি ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৯১ কোটি ২৭ লাখ টাকা সঞ্চিতি গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ইউসিবির একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির ৩৮৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা লোকসান রয়েছে, যে সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে ব্যাংকটির মালিকানা ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। নিয়ম অনুসারে ওই লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি গঠন বাধ্যতামূলক থাকলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা গঠন করেনি।

নিরীক্ষক জানিয়েছে, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি খারাপ ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে, এনবিএফআইগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ ফিক্সড ডিপোজিটের বিপরীতে এবং অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে মোট ৩ হাজার ৮৯৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা সঞ্চিতি গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি বছরের ২১ মে ইস্যু করা একটি চিঠিতেও ইউসিবিকে ৩ হাজার ৮৯৬ কোটি ২৬ লাখ টাকার সঞ্চিতি গঠনে ব্যর্থ কোম্পানি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

২০২৪ হিসাব বছরে যদি ব্যাংকটি এই বড় অঙ্কের সঞ্চিতি গঠন করত, তাহলে ব্যাংকের নিট লোকসান গিয়ে দাঁড়াত ৩ হাজার ৮৮৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। এতে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি লোকসান হতো ২৫ টাকা ৮ পয়সা। কিন্তু আলোচিত হিসাব বছরে ব্যাংকটি এই সঞ্চিতি গঠন না করে আর্থিক প্রতিবেদনে শেয়ারপ্রতি ৫ পয়সা হারে ৮ কোটি ৬ লাখ টাকা নিট মুনাফা দেখিয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকটি সঞ্চিতি গঠন না করে লোকসানকে মুনাফায় রূপান্তর করে দেখিয়েছে।

এদিকে ব্যাসেল-৩ মানদণ্ড অনুসারে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ইউসিবির প্রয়োজন ৬ হাজার ৩৫৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকার মূলধন। অথচ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের এই মূলধন ছিল মাত্র ৫ হাজার ৩৮৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যবসা পরিচালনায় ইউসিবির মূলধন ঘাটতি রয়েছে ৯৭২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এর সঙ্গে ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি যোগ করলে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের মোট ঘাটতি দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৬৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

নিরীক্ষকের মতে, ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ইউসিবির মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিআরএআর) থাকা উচিত ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে তা রয়েছে ১০ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সঞ্চিতি ঘাটতি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকটির সিআরএআর নেমে আসে মাত্র ৫ দশমিক ৪০ শতাংশে, যা রেগুলেটরি মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা এই ব্যাংকটি থেকে ঋণের নামে লুটপাট করে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সেই অর্থের বড় একটা অংশ দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। সাইফুজ্জামান চৌধুরী ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ২০১৮ সালে ব্যাংকটির পূর্ববর্তী পর্ষদের সদস্যদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং নিজ পরিবার ও সহযোগীদের ব্যাংকের পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করেন। 

স্ত্রী রুখমিলা জামানকে চেয়ারম্যান এবং ভাই আনিসুজ্জামানকে নির্বাহী কমিটির প্রধান নিযুক্ত করেন। এর মাধ্যমে ব্যাংকটিতে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে শুরু হয় লুটপাট। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে আগের পরিচালকদের অনিয়মের অনুসন্ধান শুরু করে। একই সঙ্গে ব্যাংকটিতে লুটপাটের তথ্য পেতে ফরেনসিক অডিট করা হয়। সম্প্রতি অডিট প্রতিবেদন পর্ষদের হাতে এসেছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্যউপাত্ত দুদককে জানান হয়েছে। দুদক এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্ত করে পদক্ষেপ নিবে।

এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) ইউসিবি জুবিলী রোড শাখা থেকে নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এর আগে গত ৩১ জুলাই কর্মচারীর নামে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে ১৫ কোটি টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।


বিকেপি/এমবি/ এএইচকে

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর