
চলতি ২০২৫ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) দেশের বেশিভাগ সাধারণ বিমা কোম্পানির সূরায়না কমেছে। এই সময়ে কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম ও মুনাফায় ভাটা পড়েছে। এর কারণ হিসেবে এজেন্টদের অধিক হারে কমিশন দেওয়া এবং মেরিন ও অগ্নিবিমা পলিসি কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
দেশে বর্তমানে মোট ৮২টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে ৫৭টি। যার ২০টি জীবন বিমা ও ৩৭টি সাধারণ বিমা কোম্পানি। এই সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২২টির মুনাফা চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে কমেছে এবং ১৫টির সামান্য বেড়েছে।
আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৭ সাধারণ বিমা কোম্পানির সম্মিলিত মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৯৪ কোটি টাকায়, যা ২০২৪ সালের একই সময়ে ছিল ২৯৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধে সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড, প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স পিএলসি, কোম্পানিটির মুনাফা ২৮ কোটি টাকা।
এর বাইরে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ২১ কোটি টাকা, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ১৮ কোটি টাকা এবং সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। যদিও বিগত বছরগুলোতে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোকে বছরের শেষ ছয় মাসের তুলনায় প্রথম ছয় মাসে বেশি মুনাফা করতে দেখা গেছে। তবে চলতি বছরে প্রথম ছয় মেরিন ও অগ্নিবিমা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে অর্থনীতির আকারের চেয়ে অধিক কোম্পানি থাকায় সংকট বেড়েছে এ খাতে মাসেও কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমেছে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে সম্মিলিতভাবে কোম্পানিগুলো ২৯৫ কোটি মুনাফা করলেও দ্বিতীয়ার্ধে ১৪৬ কোটি মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আগের বছরের প্রথমার্ধে ২৮৬ কোটি এবং দ্বিতীয়ার্ধে ২১৯ কোটি মুনাফা করেছিল কোম্পানিগুলো।
খাত সংশ্লিষ্টরা কী বলছেন
সাধারণ বিমা খাতের একাধিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এতে প্রায় সব ধরনের ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিমা খাতেও যার প্রভাব পড়ছে। আমদানি কমে যাওয়ায় মেরিন বিমা কমেছে। অগ্নিবিমাও আগের তুলনায় কমেছে। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন কম হারে কাভারেজ নিচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবে বিমা খাতের ব্যবসা সংকুচিত হচ্ছে।
প্রগতি ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের উপদেষ্টা মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘ব্যবসা সংকুচিত হওয়ায় মেরিন ও ফায়ার ইনসুরেন্স বিক্রি কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বিমা করলেও আগের তুলনায় কম কভারেজ নিচ্ছে। যেসব কোম্পানি আগে ১ কোটি টাকার কভারেজ নেওয়ার জন্য প্রিমিয়াম দিত, এখন তারা অর্ধেক পরিমাণে বিমা নিচ্ছে। এটি বিমা কোম্পানিগুলোর জন্য ঝুঁকির মাত্রা বৃদ্ধি করছে।’
তিনি বলেন, মুনাফা কমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো এজেন্ট কমিশন নিয়ে চরম প্রতিযোগিতা। একদিকে ব্যবসার পরিবেশ অনুকূলে নয়, অন্যদিকে এজেন্টদের কমিশ নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে বিমা কোম্পানিগুলোর মুনাফাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এজেন্ট কমিশন প্রিমিয়ামের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু অনেক কোম্পানি এখন ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিচ্ছে। যদি কোনো কোম্পানিকে কমিশনের পেছনে তার প্রিমিয়াম আয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খরচ করতে হয়, আর পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার খরচও বহন করতে হয়, তাহলে তারা লাভ করবে কীভাবে?
এটি বিমা কোম্পানির মুনাফা কমার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা সময় ছিল যখন কেবল ছোট কোম্পানিগুলো উচ্চ কমিশন দিত, কিন্তু এখন অনেক বড় কোম্পানিও একই কাজ করছে। ফলস্বরূপ, বিমা কোম্পানিগুলোর মুনাফা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কোম্পানির সংখ্যাধিক্য খাতকে সংকটে ফেলছে
অর্থনৈতিক আকার বিবেচনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিমা কোম্পানির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে বিমা কোম্পানি রয়েছে ৫৮টি। যেখানে অনেক ছোট অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিমা কোম্পানির সংখ্যা ৮২টি। দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বিমা খাতের অবদানের বিবেচনায়ও বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। দেশের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশের আশপাশে।
যেখানে ভারতের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান ৪ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালে ভারতের বিমা খাতে গ্রস প্রিমিয়াম ছিল প্রায় ৬ লাখ কোটি রুপি, যেখানে বাংলাদেশের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। ভারতের বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার বার্ষিক আয় যেখানে প্রায় ৬০০ কোটি রুপি, সেখানে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আইডিআরএর প্রস্তাবিত আয় ৩৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং ব্যয় ৩৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিমা কোম্পানির সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় আয় ও জিডিপিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তানের ৫৪টি, ভিয়েতনামের ৫৩টি, নাইজেরিয়ায় ৫৭টি, নেপালে ৩৪টি, শ্রীলঙ্কায় ২৭টি এবং থাইল্যান্ডের ৭৪টি বিমা কোম্পানি দেশের অর্থনীতিতে যে পরিমান অবদান রাখছে বাংলাদেশ তা পারছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এত ছোট দেশের জন্য এতগুলো বিমা কোম্পানি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী গ্রাহক না পাওয়ায় কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সংকুচিত হয়। ফলে ধীরে ধীরে তারল্য সংকট তৈরি হয়। কোম্পানির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধে বিলম্ব হয়। সরকারের উচিত দুর্বল বিমা কোম্পানিগুলোকে একীভূত করে খাতকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নেওয়া। সংখ্যা কমিয়ে কোম্পানিগুলোকে শক্তিশালী করা গেলে গ্রাহক আস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি খাতটিও সম্ভবনাময় হয়ে উঠবে। এতে কোম্পানির মুনাফা রেশিও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে।