Logo

অর্থনীতি

উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন বেসরকারি ব্যাংকের এমডিরা

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৫, ১৬:১৯

উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন বেসরকারি ব্যাংকের এমডিরা

গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর

চলতি বছরের ৩১ জুলাই থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত গত প্রায় দেড় মাসের ব্যবধানে বেসরকারি চার ব্যাংকের চারজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের তালিকায় রয়েছেন সাউথইস্ট ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক এবং সর্বশেষ ঢাকা ব্যাংকের এমডি।

জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর এই তিন ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।  এরপর পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় মেঘনা ও কমার্স ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেন।

হঠাৎ করে দুই এমডির পদত্যাগ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে আর্থিকখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্ষদ পুনর্গঠন করা ব্যাংকের মধ্যে কমার্স ব্যাংক ছিল এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ও মেঘনা ব্যাংক ছিল সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকিং নিয়মে কোনো এমডি পদত্যাগ করলে বাংলাদেশ ব্যাংককে তার কারণ জানাতে হয়।  এরপর সেই পদত্যাগ কার্যকর হবে কি না, সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে পদত্যাগ করা এমডিকে কাজে ফিরিয়ে দেওয়ার উদাহরণও রয়েছে। তবে রাজনৈতিক চাপের কাছে অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকও সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হয়েছে।

পরিপূর্ণ ও একক সিদ্ধান্তের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন এখন তাই সময়ের দাবি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে এমডিদের ওপর কোনো অযৌক্তিক বিষয় চাপিয়ে দেয়া যাবে না।

এমডিদের পদত্যাগের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত ঘিরে সৃষ্ট বিতর্কের জেরে পদত্যাগ করেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন।  বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে মোশারফ হোসেনের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন কয়েকজন পর্ষদ সদস্য। পরদিনই পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি।

এ বিষয়ে ব্যাংকটি গণমাধ্যমকে জানায়, এমডি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন।  মোশারফ হোসেন চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি কমার্স ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগ দেন।

চলতি মাসেই পদত্যাগ করেন সাউথইস্ট ব্যাংকের এমডি নুরুদ্দিন মো. ছাদেক হোসেন। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বরাবরে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি।

যদিও চলতি বছরের ৪ মে তাকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠিয়েছিল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। একইভাবে পদত্যাগ করেন মেঘনা ব্যাংকের এমডি কাজী আহসান খলিল। গত বছরের এপ্রিলে ৩ বছরের জন্য তিনি ব্যাংকটির এমডি হিসেবে যোগ দেন।  তবে ১৫ মাসের মাথায় এসে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন।

পদত্যাগের বিষয়ে কাজী আহ্সান খলিল বলেন, ‘হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে ছুটিতে পাঠায় ব্যাংকটির নতুন পর্ষদ।  আমি সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে নিজেই পদত্যাগ করেছি।  বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করলেই আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন।’

এর আগে চলতি বছরের মার্চে মেঘনা ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির শেয়ারধারী পরিচালকের পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। যাদের দুজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা।

ব্যাংক এমডিদের পদত্যাগের মিছিলে সবশেষ যুক্ত হয়েছেন ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে তিনি পদত্যাগ করেছেন। এ নিয়ে ব্যাংক পাড়ায় আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

এসব বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছু ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ বা পরিবর্তন করা অনুমেয় ছিল। কেননা বিগত সরকারের আমলে আর্থিক খাতের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংক খাত।  কাজেই দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে ব্যাংকের এমডিরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঋণ খেলাপি ও আর্থিক লুটপাটের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি একটি কারণ হতে পারে। এছাড়া সাধারণভাবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে দ্বন্দ্বও আরেকটি বড় কারণ  হতে পারে।’

হঠাৎ করে এমডিরা কেন পদত্যাগ করছেন জানতে চাইলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ব্যাংকের একজন এমডিকে প্রায় সবগুলো ধাপ অতিক্রম করেই ব্যবস্থাপক (এমডি) হতে হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন এমডির পদত্যাগের পেছনে ব্যাংকের ভেতরে অন্তঃকলহ কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়।  কিন্তু প্রবলেম থাকবেই, সেটা ফেস করেই কাজ করতে হবে।  নির্বাচন আসলে এমডিরা অতিরিক্ত চাপে থাকেন এটা সত্য, কিন্তু সেই চাপ ফেইস করার ক্যাপাসিটিও তাদের থাকতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসময় বড় ঋণ গৃহীতাদের কেউ কেউ তাদের ‍ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেন। সেটার যৌক্তিকতা বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয় এমডিদেরই। এ ক্ষেত্রে পর্ষদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী, অর্থমন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারি ব্যাংকের এমডিদের বেতন নির্ধারিত হয়। তবে বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে রয়েছে এর ভিন্নতা। এমডিদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

অর্থমন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের হিসাবে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন মেঘনা ব্যাংকের এমডি। সাউথইস্ট ব্যাংকের এমডির বেতন ছিল ৭ লাখ ৮৭ হাজার, ঢাকা ব্যাংকের এমডির বেতন ৬ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এমডি বেতন পেতেন ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে তার ভাতা যুক্ত হবে। এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি থেকে তিনি বাসা ভাড়া ও ব্যবহারের গাড়ি এবং ড্রাইভার পেতেন।  

  • এমআই/এআরএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বেসরকারি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর