বিএফআইইউ প্রধানের পদ হারাচ্ছেন শাহীনুল ইসলাম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৫৫
---2025-08-23T155342-68a99029301e2.jpg)
ছবি : সংগৃহীত
আপত্তিকর ভিডিও ভাইরালের পর শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। শাহীনুল তার দেয়া বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শৃঙ্খলা ভেঙেছেন।
বুধবার (২০ আগস্ট) গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শাহীনুল বলেন, ‘আমি তো গভর্নরের অধীনে চাকরি করি না। তিনি বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়ার কে? তার কী ভিত্তি রয়েছে? তার কোনো অধিকার নেই। আমার অফিস বাংলাদেশ ব্যাংকে হওয়ায় আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসে অফিস করছি। যারা আন্দোলন করছেন বা হুমকি দিচ্ছেন, তারা বৃথা আস্ফালন করছে।’
বিএফআইইউ প্রধানের এমন বক্তব্যে ব্যাপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আন্দোলনরত কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, গভর্নরের দফতরের অনুরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাকে শাহীনুলকে জুতা নিক্ষেপ কর্মসূচি থেকে বিরত ছিলেন। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা আরও বলেন, যেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন সেকারণে আমরা আমাদের কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করছি। তবে কর্মসূচি প্রত্যাহা করিনি। তার মত একজন নৈতিকস্খলিত ব্যক্তি যেন বাংলাদেশ ব্যাংকে আর না ফেরেন আমরা এই প্রত্যাশা করব।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর বলেন, শাহীনুলের এই ধরনের মন্তব্য গভর্নরের জন্য সম্মানহানিকর। যদি শাহীনুল রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবে শাহীনুলের ভাষায় ‘হাই কমান্ডের নির্দেশ’ মেনে আবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফেরত আসেন, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তারাও শৃঙ্খলা ভঙ্গে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শুদ্ধাচার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী হবে। আগামীতে আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। যা দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ন করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, গভর্নরের দেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শাহীনুল ছুটিতেই থাকবেন। তাকে গভর্নরের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও বিষয়টি তাকে শাহীনুলকে জানিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বাংলাদেশের খবরকে জানান, ‘ভিডিও সঠিক প্রমাণ হলে পদ হারাতে পারেন বিএফআইইউর প্রধান শাহীনুল ইসলাম। যেহেতু তদন্ত চলছে আপাতত এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।’
এদিকে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৃতীয় তলা গিয়ে দেখা যায়, বিএফআইইউ প্রধান অফিসে আসেননি। শাহীনুর না হলেও তার বহিষ্কারের দাবিতে ক্ষোভে ফুঁসেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান হিসেবে শাহীনুর ইসলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্পর্কে এমন বক্তব্য দিতে পারেন না। তার নৈতিকস্খলনের কারণে নারী সহকর্মীরাও তার সঙ্গে একই অফিসে কাজ করতে ইতস্তত বোধ করছেন। ভবিষ্যতে যা তাদের সামাজিকভাবে হেয় করতে পাবে। যে কারণে শাহীনুলকে প্রত্যাহার করে নতুন বিএফআইইউ প্রধান হিসেবে অন্য কাউকে বসানোর দরকার।
গত ১৮ আগস্ট শাহীনুল ইসলামের একাধিক আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার জেরে এ স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। যদিও তিনি এসব ভিডিওকে ভুয়া দাবি করেন, তবে প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ভিডিও সঠিক বলে জানতে পেরেছে।
এছাড়া, বিতর্কিত পরিবহন ব্যবসায়ী এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার পরও সেখান থেকে ১৯ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ করে দেন শাহীনুল। এ ঘটনায় কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়েছে কিনা, তাও তদন্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
এর আগে, গত বছরের ১২ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বিএফআইইউর তৎকালীন প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। ওই সময় প্রায় পাঁচ মাস দায়িত্ব পালন করেন বিএফআইইউর নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান। অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসীকাতার সঙ্গে বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলোর দুর্নীতি ও অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার উদ্যোগ নেন। তিনি। তার সফলতার ফলে দেশের ব্যাংকখাতে লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসছে প্রকাশ্যে। পরে চলতি বছরের শুরুতে শাহীনুল ইসলামকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৃতীয় তলায় সাংবাদিকদের যাতায়াতের ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় এই সময়ে।
জানা গেছে, শাহীনুলের নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল বিতর্কিত ও অস্বচ্ছ। এফআইইউর প্রধান পদে নিয়োগের জন্য গত বছরের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটসহ একাধিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে ২৭ জন্য ব্যক্তি আবেদন করেন। প্রাথমিক বাছাই শেষে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ২০ জনের। গভর্নরের সভাপতিত্বে ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভায় তিনজনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়, যাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতা ও মেধাক্রমের ভিত্তিতে প্রথম ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম। দ্বিতীয় ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রংপুর কার্যালয়ে কর্মরত নির্বাহী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম এবং তৃতীয় ছিলেন এ কে এম এহসান। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বছরের ৯ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের জন্য যে সারসংক্ষেপ পাঠায়, তাতে তিনজনের নামই উল্লেখ করা হয়। তবে তিনজনের মধ্যে প্রথম হওয়ার কারণে এ এফ এম শাহীনুল ইসলামকে দুই বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দিতে সেই সারসংক্ষেপে সুপারিশ করা হয়।
শিক্ষাগত যোগ্যতা, সরকারের অর্থ বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান–সংক্রান্ত কার্যক্রম বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধ–সংক্রান্ত কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে কমিটির সদস্যরা তিনজনকে বাছাই করেন বলে সূত্রগুলো জানা গেছে। বিএফআইইউ প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলামের একাধিক বিতর্কিত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার জেরে গত ১৯ আগস্ট আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ও দুজন নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিকে সহায়তা করবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
বিতর্কিত এই ব্যক্তি বিএফআইইউর ডেপুটি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিতর্কিত শিল্প গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপসহ কয়েকটি গ্রুপ বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার ও লুটপাটের অভিযোগ উঠলেও তিনি কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেননি। পাল্টা সাংবাদিকদের ব্যাংকের তৃতীয় তলায় উঠা নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেন। দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম সপ্তাহে সাংবাদিকদের নিজের রুমে ডেকে নিয়ে নৈতিকতার সবক দিন শাহীনুল।
ওই সময় তিনি বলেন, ‘একটি বড় গ্রুপে কত লোক কাজ করতে পারে আপনাদের জানা আছে? আপনার একটি নেগেটিভ নিউজ তাদের জীবনেকে কষ্টে ফেলে দিতে পারে। এ জন্য আখেরাতে আপনাকে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। অতএব সবকিছুতেই নিউজ করতে নেই।’
- এএইচএস/এমআই