Logo

অর্থনীতি

জুলাই গণহত্যা মামলার ৩ আসামি এখনো মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫৪

আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৫

প্রথম পর্ব : জুলাই গণহত্যা মামলার তিন আসামি এখনও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তাদের একজন জেলে থাকলেও বাকি দু’জন মতিঝিলের একজন প্রভাবশালী বিএনপি নেতার ছত্রছায়ায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। জুলাই গণহত্যা মামলায় এজাহারনামীয় আসামি হলেও গ্রেপ্তার এড়ানোর বিনিময়ে ওই নেতাকে নিয়মিত মাসোহারা দিতে হচ্ছে ব্যাংকের এই পরিচালকদের। পরিচালকরা সবাই নিয়মিত বেতন, ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, পরিচালনা পরিষদে পরপর তিনটি মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকলে পরিচালক পদ বাতিল হয়ে যায়।

জানা গেছে, গত ৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর গুলশান-২ থেকে বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক মোরশেদ আলমকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। এরপর ৯ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজা শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এই রিপোর্ট প্রকাশের সময় পর্যন্ত তিনি কারাগারে রয়েছেন। 

মামলার সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের হোটেল চিলিসের সামনে আন্দোলনে অংশ নেন মো. শামীম (১৩)। মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা ওইদিন বিকেলে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করলে শামীম আগুনে দগ্ধ হন। পরে ৬ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় গত ৩ অক্টোবর ভুক্তভোগীর মা জাহানারা বেগম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২৮ জনের নাম উল্লেখ করে ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন। মোরশেদ আলম এই মামলার আসামি। তিনি ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-২ (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী উপজেলার একাংশ) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

অপর দু’জন পরিচালকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কাজলা এলাকায় বেলা ১২ থেকে ২টার মধ্যে স্থানীয় জনসাধারণ শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় ১-থেকে ৮ নম্বর আসামি পুলিশের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ছাত্র-জনতার ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেন। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুলিতে মামলার বাদী মো. মুজাহিদুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। এই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গুলি চালালে বাদীসহ অসংখ্য ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধসহ আহত হন। ওইদিন যাত্রাবাড়ী ও কাজলা এলাকার বিভিন্ন ভবনের ছাদ থেকেও ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করেন আসামিরা। এই ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জান খান কামাল, পুলিশের আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই গণহত্যা চালানো হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ ঘটনায় শতাধিক ছাত্র-জনতা নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ঘটনার পর দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ও বাদী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় তখন মামলা করতে পারেননি। পরে ১৪ অক্টোবর মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করায় বাদী ন্যায়বিচার পেতে আদালতে নালিশি আবেদন করেন। গত ২১ অক্টোবর বাদী চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা দায়ের করেন (মামলা নং ৭৯৮)। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২৫০ জনকে। এই মামলায় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন হুমায়ুনকে ৩৯ নম্বর আসামি করা হয়েছে।

এছাড়া একই বছরের ১৫ অক্টোবর শাহবাগ থানায় ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার হামলা ও গণহত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা (নং ১২) দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলায় ১১ নম্বর আসামি করা হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আরেক পরিচালক ও পটুয়াখালী থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী এ এস এম ফিরোজ আলম ওরফে জাপানি ফিরোজকে।

ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা বিএনপি নেতা মো. আব্দুল হান্নানের সঙ্গে বোর্ড সদস্যদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বা হবে জানতে চেয়ে কল করে ও তার হোয়াটঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, জুলাই গণহত্যা মামলার আসামি এ এস এম ফিরোজ আলম গ্রেপ্তার এড়াতে পলাতক আছেন। তবে ব্যাংকের পরিচালক পদ হারানোর শঙ্কায় বিএনপির একজন সিনিয়র নেতার ছত্রছায়ায় গোপনে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভায় হাজিরা দিচ্ছেন তিনি। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি মুঠোফোন ব্যবহার করেন না বলেও জানা গেছে। পলাতক থাকায় তার কোনো মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান পদে আছেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেন হুমায়ুন। মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমার পক্ষে যাত্রাবাড়ী বা কাজলায় গিয়ে রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর ও মানুষ হত্যায় কীভাবে অংশ নেওয়া সম্ভব?

আগাম জামিন অথবা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলা প্রত্যাহার হয়নি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগে ভিত্তিহীন হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা হয়েছে, এমন ব্যক্তিদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমিও আবেদন করেছি। যথাযথ তথ্য প্রমাণ তদন্তের পর আদালতে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা হবে। একজন পুলিশ সুপার (এসপি) বিষয়টি তদন্ত করে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেবেন বলেও জেনেছি। ওই মামলার এখনো চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়নি।

আকরাম হোসাইন হুমায়ুন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, গত ১০ বছর আওয়ামী লীগের কোনো মিছিল, মিটিং এমনকি কোনো ঘরোয়া মিটিং-এও যাইনি। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগ আমাকে অনার করে ওই পদটি দিয়েছে। যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন যে আমি ওইসব প্রোগ্রামে গিয়েছি, তাহলে আমি প্রতিদিনের জন্য তাকে ১০ হাজার টাকা করে দিবো।

ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনার (মোরশেদ আলম) কথা ভিন্ন। তিনি সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি এবং সুবিধাভোগী ছিলেন। আমি কখনো সরকারের কোনো সুবিধা নেইনি। নেওয়ার প্রয়োজনও পড়েনি।

ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়েও অনিয়মিত থাকার বিষয়ে আকরাম বলেন, প্রতিমাসে আমাদের একটি থেকে সর্বোচ্চ দুটি বোর্ড মিটিং হয়। ব্যাংক আইনে পর পর তিন মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকলে পরিচালক পদ বাতিল হয়ে যায়। আমি হার্টের রোগী, শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রায়ই বোর্ডে যেতে পারি না। সেজন্য আগেই বোর্ডে চিঠি দিয়ে ছুটি নিয়েছি।

এদিকে ওই মামলার কপিতে বাদীর দেওয়া নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। মামলায় বাদীর নাম দেওয়া হয়েছে মো. মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি নিজেকে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় বিএনপির একজন নেতার ছত্রছায়া ব্যাংকের বোর্ডের সদস্য পদ টিকিয়ে রাখতে মাঝেমধ্যে বোর্ডের মিটিংয়ে হাজিরা দিচ্ছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দুজন পরিচালক। আরেকজন জেলে থাকায় তিনি চিঠি দিয়ে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আসতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল হামীদ সোহাগ বাংলাদেশের খবরকে জানান, ‘বিষয়টি স্যারদের একান্ত ব্যক্তিগত। সে কারণে আমার পক্ষে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।’ তবে তিনি বোর্ড মিটিংয়ে পরিচালকদের টানা অনুপস্থিতির কথা স্বীকার করেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, ব্যাংকের পরিচালকদের বিষয়ে আরও জোরদার মনিটরিং করা হচ্ছে। তবে যদি কোনো ব্যাংক পরিচালক পরপর তিন বোর্ড মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকেন অথবা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তার পরিচালক পদ বাতিল হবে। আর নৈতিক দিক বিবেচনা করলে যদি গণহত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি কোনো ব্যাংক পরিচালক জড়িত থাকেন, তাহলে তার স্বেচ্ছায় সরে যাওয়া উচিত। 

এএইচএস/এমএইচএস/এএইচকে

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসি জুলাই অভ্যুত্থান বেসরকারি ব্যাংক

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর