Logo

অর্থনীতি

১০ দিনে দাম বেড়ে দ্বিগুণ, পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা কেন

Icon

বাংলাদেশের প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৭

১০ দিনে দাম বেড়ে দ্বিগুণ, পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা কেন

ফাইল ছবি

দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। রাজধানীসহ সারাদেশের খুচরা বাজারে বর্তমানে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১১০ থেকে ১২০ টাকায়, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। এই অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধিতে অস্থির হয়ে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা, আর বিতর্কের মুখে পড়েছে সরকার ও ব্যবসায়ীদের আমদানি নীতি।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকায়। ঢাকার কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, আগারগাঁও, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও রাজশাহীর পাইকারি বাজারে প্রতিদিনই কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা করে দাম বাড়ছে।

ঢাকার উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা রুবেল হোসেনের ক্ষোভ, ‘গত সপ্তাহে ৬০ টাকায় পেঁয়াজ কিনেছি, আজ ১২০ টাকায়। বাজারে এখন কোনো কিছুরই দাম বোঝা যাচ্ছে না।’

রাজধানীর গুদারাঘাট বাজারের খুচরা বিক্রেতা রিপন মিয়া বলেন, ‘গতকাল ১০০ টাকায় বেচেছি, আজ ১২০ টাকায় বিক্রি করছি। পাইকারিতে যত দামে কিনি, তত দামে তো বিক্রি করবই। দাম প্রতিদিনই বাড়ছে।’

এদিকে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি (আইপি) বন্ধ থাকায় সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে না আসা পর্যন্ত দাম আরও বাড়তে পারে।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী নেতা আহসান উল্লাহ জাহেদী বলেন, ‘সরকার যদি আজই আমদানির অনুমতি দেয়, দুই দিনের মধ্যেই দাম অর্ধেকে নেমে আসবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আইপি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ পড়েছে।’

তবে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ব্যবসায়ীদের দাবি মানতে নারাজ। সংগঠনের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘এখন বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আছে। নতুন ফসল ঘরে তুলতে দেরি হচ্ছে বটে, তবে ঘাটতির কোনো কারণ নেই। এটি এক ধরনের কৃত্রিম সংকট, যাতে সরকারকে আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য করা যায়।’

বাজার তদারকির দুর্বলতাও এই অস্থিরতার বড় কারণ বলে মনে করেন ক্যাবের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘যেভাবে একদিনে ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দামে বাড়ছে, তা অস্বাভাবিক। স্টক পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে।’ 

সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ। তবে এখনো এক বছর আগের তুলনায় দাম ২২ শতাংশ কম। টিসিবির মতে, বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও অজানা কারণে দাম বেড়ে চলেছে।

অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নভেম্বরের শেষ নাগাদ বাজারে আসবে। অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘এখন আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন। কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করাই সরকারের অগ্রাধিকার।’

তবে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, দেশে দৈনিক পেঁয়াজের চাহিদা ছয় থেকে সাত হাজার টন। বর্তমানে মাঠে চাষিদের ঘরে পেঁয়াজ নেই বললেই চলে। মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসতে আরও দেড় মাস সময় লাগবে। ফলে আমদানির বিকল্প নেই।

এই অবস্থায় বাজারে কারসাজির অভিযোগও উঠেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. জামাল উদ্দীন বলেন, ‘এই মুহূর্তে দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই। এটি পরিকল্পিত কারসাজি ছাড়া কিছু নয়। যারা অতীতে সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, তারা ফের সক্রিয় হয়েছে।’

অন্যদিকে মাঠের কৃষকরা চান আমদানি বন্ধ থাকুক। পাবনার চাটমোহরের কৃষক রণজিৎ চন্দ্র দাশ বলেন, ‘আমরা কেজিপ্রতি ৪০ টাকা খরচে পেঁয়াজ উৎপাদন করছি। এখন ভারতীয় পেঁয়াজ এলে আমাদের ফসল বিক্রি হবে না। তখন বড় ক্ষতির মুখে পড়ব।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ থেকে ২৭ লাখ টন, আর দেশীয় উৎপাদন প্রায় ৩৫ লাখ টনের কাছাকাছি। তবে সংরক্ষণে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. এমদাদ উল্লাহ বলেন, ‘আমরা ভারসাম্য রাখতে চাই— কৃষক যেন ন্যায্য দাম পান, আবার ভোক্তাও যেন সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনতে পারেন। এজন্য সরকার সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করেছে ও কৃষকদের উন্নত জাতের বীজ ও সার দিয়েছে।’

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—কৃত্রিম সংকট রোধ করে বাজারে স্বচ্ছ সরবরাহ নিশ্চিত করা। তদারকি জোরদার না করলে দাম আরও বাড়বে, আর সেটির বোঝা পড়বে সাধারণ ক্রেতার কাঁধেই।

সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকি ও সিন্ডিকেটবিরোধী অভিযান না বাড়ালে, পেঁয়াজের এই অস্থিরতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমএইচএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বাজার দর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর