এ সরকারের আমলেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক
এস রহমান খান
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১০
অন্তর্বর্তী সরকারের শাসন আমলেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে পাঠিয়েছে সরকারের কাছে। কেবল খসড়া নয়, অধ্যাদেশটি যাতে দ্রুত জারি হয়, তার জন্য গভর্নর সরকারকে চিঠিও দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে ব্যাপক আইনি সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে খসড়ায়। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা সরকারের সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদমর্যাদা হবে দেশের একজন পূর্ণ মন্ত্রীর সমান। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি কমবে। এ ছাড়া গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের নিয়োগ হবে ‘সার্চ’ বা অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে। গভর্নর অধ্যাদেশটি জারির আশা করছেন নির্বাচনের আগেই। এজন্য সম্প্রতি তিনি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেককে গভর্নর আলাদা চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিদ্যমান বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ সংশোধন করে এ অধ্যাদেশ করা হচ্ছে। অধ্যাদেশ জারির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উপদেষ্টা ও সচিবদের সহযোগিতা চান তিনি।
চিঠিতে গভর্নর বলেছেন, এ ধরনের সংশোধন আনতে অতীতে একাধিকবার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু রাজনৈতিক কারণ ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ অর্ডার সংশোধন করার জন্য বর্তমান সময়টিই সবচেয়ে উপযুক্ত। এটি করা গেলে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ন অবদান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমাদের তরফ থেকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে যাতে দ্রুত অধ্যাদেশটি জারি করা যায়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বাড়বে। ব্যাংকিং খাতের শাসন-তদারকি জোরালো হবে। ফলে অনিয়ম দুর্নীতি রোধ করা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত হয়। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেয় সরকার। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা রাষ্ট্রাচারের মর্যাদাক্রমে গভর্নরের অবস্থান এখন সচিবদের ওপরে। তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নিচে। সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা হয়, যাতে তারা স্বাধীনভাবে নীতিনির্ধারণ করতে পারে। অবশ্য বাংলাদেশে সা¤প্রতিক অতীতে গভর্নর পদে থাকা ব্যক্তিদের সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে ভূমিকা রাখতেই বেশি দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গভর্নরকে মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন আমলারা।
অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এখানে যতটা আইনি দুর্বলতা ছিলো, তার থেকে বেশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কাজ করেছে। শীর্ষ নির্বাহীরা সরকারের তোষামোদে ব্যস্ত থেকেছেন। কেবল, গভর্নরকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিলেই শক্তিশালী
হবে না, কাজটা ঠিক মতো করতে হবে। তবে, মনে রাখতে হবে জনস্বার্থ আর রাজনৈতিক বিষয়টিও।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বর্তমানে নয়জন সদস্য রয়েছেন, যার চেয়ারম্যান গভর্নর। আরও থাকেন অর্থসচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, একজন ডেপুটি গভর্নর এবং বেসরকারি খাত থেকে চারজন। অধ্যাদেশের খসড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি বর্তমানের তিনজন থেকে কমিয়ে একজন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর পদে নিয়োগপ্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও পেশাদার করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি ও সরকারের মাধ্যমে যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে তিন সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটির নেতৃত্ব দেবেন সাবেক অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনামন্ত্রী বা পরিকল্পনা উপদেষ্টা অথবা একজন বিদায়ী বা সাবেক গভর্নর। সার্চ কমিটির গঠন, কার্যপরিধি ও প্রক্রিয়া আলাদা বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
নিজস্ব জনবলের বেতনকাঠামো বাংলাদেশ ব্যাংক নিজে ঠিক করবে এবং পদ সৃষ্টিসহ শীর্ষ পর্যায়ের নিয়োগও নিজেই দেবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে অধ্যাদেশের খসড়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন তিন কোটি টাকা। খসড়া অধ্যাদেশে এ আকার ৩৩ গুণের বেশি বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ড. এ কে এনামুল হক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, কেবল অতিক্ষমতাশালী করলে সুফল আসবে না। একই সঙ্গে তার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে যে পচন তৈরি হয়, তার দায় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। একই সঙ্গে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হলে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারবে না।
বিকেপি/এমবি

