বেবি শার্ক
৯০ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপ যেভাবে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা
ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:৩৩
কিম মিন-সিওক যখন ২০১৬ সালের জুনে ৯০ সেকেন্ডের একটি শিশুদের গানের ভিডিও ক্লিপ প্রকাশের অনুমোদন দেন, তখন তার ধারণাই ছিল না যে তিনি কী প্রকাশ করছেন।
এটি ১৬ বিলিয়ন বা ১৬০০ কোটিরও বেশি ভিউ পেয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে- ইউটিউবে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বার দেখা ভিডিওতে পরিণত হয়।
আর অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণ সৃষ্টি করা সেই গানটি ছিল বেবি শার্ক। এটি কেবল ছোট বাচ্চাদেরকেই মোহিত করেনি, ভিডিও ক্লিপটির স্রষ্টা পিঙ্কফং-এর জন্য কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের মিডিয়া ব্যবসা গড়ে তোলার ভিত্তিও স্থাপন করেছে।
‘আমরা আশা করিনি যে এটি আমাদের অন্যান্য কনটেন্ট থেকে আলাদা কিছু হয়ে উঠবে,’ সোলে অবস্থিত ফার্মের সদর দপ্তর থেকে বিবিসিকে বলেন পিঙ্কফং-এর প্রধান নির্বাহী কিম মিন-সিওক।
‘কিন্তু পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় যা বিশ্বব্যাপী আমাদের যাত্রার মঞ্চ তৈরি করেছে।’
মঙ্গলবার সেই যাত্রা পিঙ্কফংকে দক্ষিণ কোরিয়ার শেয়ার বাজারে নিয়ে যায়, যেখানে তাদের শেয়ারের দাম আত্মপ্রকাশের সময়েই ৯ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে, যার ফলে পিঙ্কফং-এর মূল্যায়ন এখন ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
‘আমরা বেতন আশা করিনি’
স্মার্টস্টাডি নামে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ফার্মটি ১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করছিল।
এটির মাত্র তিনজন কর্মচারী ছিল, যাদের মধ্যে ছিলেন কিম মিন ও ফার্মের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা ডংউ সন।
‘অফিসটি ছিল ছোট - এমনকি এর চেয়েও ছোট,’ তিনি যে কনফারেন্স রুম থেকে কথা বলছিলেন সেটির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন কিম মিন।
এটি এত ছোট ছিল যে ‘আমরা তখন বেতনও আশা করিনি’।
পিঙ্কফং বেশ কয়েকটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, যার একটি হচ্ছে, ছোট বাচ্চাদের দিকে মনোনিবেশ করা।
পরবর্তীতে ফার্মটি প্রায় ১০০ জন কর্মচারী নিয়োগ করে এবং কনটেন্টের ক্ষেত্রে সহজ, শিক্ষামূলক গেম ও বিষয়বস্তুকে অগ্রাধিকার দেয়। ‘এবং তখনই বেবি শার্কের আবির্ভাব হয়,’ বলেন কিম মিন।
কোম্পানিটি ২০২২ সাল থেকে পিঙ্কফং নামে পরিচিতি পায়, এই নামকরণ একটি প্রফুল্ল আর কৌতূহলী শিয়াল থেকে অনুপ্রাণিত, যে শিয়াল চরিত্রটিকে তাদের তৈরি প্রথম দিককার কার্টুনে দেখা গিয়েছিল।
বর্তমানে টোকিও, সাংহাই ও লস অ্যাঞ্জেলেসে অফিসসহ প্রায় ৩৪০ জন কর্মচারী রয়েছে কোম্পানিটির।
‘বেবি শার্ক, ডু, ডু, ডু, ডু, ডু’
বেবি শার্কের উৎপত্তি ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং গানটি প্রায়ই শিশুদের গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে গাওয়া হত বলে ধারণা করা হয়।
নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির মিডিয়া বিশ্লেষক কেভিন চিউ বলেন, ‘বেবি শার্ক, ডু, ডু, ডু, ডু, ডু’ গানটির এই বাক্যাংশটি ‘শিশুদের আকৃষ্ট করে, যদিও সম্ভবত অনেক প্রাপ্তবয়স্কের কাছেই এটি বিরক্তিকর’।
কিম মিনও জানেন গানটি শিশুদের কতটা আকৃষ্ট করে।
‘এটি একটি কে-পপ গানের মতো। খুব দ্রুতগতির, ছন্দময় এবং আসক্তিকর,’ তিনি বলেন যে গানের সুরটিতে একটি পুনরাবৃত্তি করে গাওয়ার প্রভাব রয়েছে, যা শিশুদের জন্য মনে রাখার ব্যাপারটা সহজ করে তোলে।
গানটি তাৎক্ষণিকভাবে হিট হয়েছিল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শিশুদের অনুষ্ঠানে নাচের সঙ্গে প্রদর্শিত হওয়ার পর এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
গানটির তালে শিশু আর প্রাপ্তবয়স্কদের নাচের ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং ক্লিপ ভাইরাল হয়।
কিম মিন বলেন, পিঙ্কফং অফিসে ‘উৎসবের মতো অনুভূতি’ হচ্ছিল, কারণ তারা গানটির ভিউ ক্রমাগত বাড়তে দেখছিল।
২০২০ সালের নভেম্বরে, বেবি শার্ক ক্লিপটি ইউটিউবের সর্বাধিক দেখা ভিডিও হয়ে ওঠে।
ভিডিওটি প্রকাশের পরপরই প্রতিষ্ঠানটির মোট আয়ের প্রায় অর্ধেকটা আসে এই কনটেন্ট থেকে, বলেন কিম মিন।
কিন্তু পিঙ্কফং ২০১৯ সালে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, যখন একজন মার্কিন সুরকারের কাজ চুরি করার অভিযোগ ওঠে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে।
তবে পিঙ্কফং-এর যুক্তি ছিল যে গানের সংস্করণটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত একটি লোকসঙ্গীত থেকে নেওয়া হয়েছে। এরপর মামলাটি খারিজ করে দেয় দক্ষিণ কোরিয়ার সুপ্রিম কোর্ট।
কিম মিন বলেন, এই জয় কোম্পানিটিকে আরো উৎসাহিত করে কারণ এর শেয়ারগুলি জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যায়।
একটি মাত্র হিট দেওয়া বিস্ময়?
পিঙ্কফং-এর অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি যেমন বেবেফিন ও সিলুক দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং ফার্মটিকে প্রমাণ করতে হবে যে তাদের সাফল্য কেবল বেবি শার্কের উপর নির্ভরশীল নয়, বলছিলেন কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মিন জং কিম বলেন।
কোম্পানিটি যে ধরনের দর্শকদেরকে লক্ষ্য করে কনটেন্ট দিচ্ছে তারাও একটি বড় সুবিধা তৈরি করেছে, কারণ ছোট বাচ্চারা একই কনটেন্ট বারবার দেখে থাকে।
কিম মিন-সিওক জোর দিয়ে বলেন যে, তার ব্যবসা বেবি শার্কের বাইরেও বৃদ্ধি পেতে পারে, যা বর্তমানে পিঙ্কফং-এর আয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। ইতিমধ্যে, বেবেফিন এগিয়ে যাচ্ছে, যেটি থেকে তাদের আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ আসছে।
একজন অভিভাবক বিবিসিকে বলেছেন যে পিঙ্কফং-এর ভিডিও সম্পর্কে তার পরিবারের মিশ্র অনুভূতি রয়েছে।
দুই সন্তানের বাবা সেলিম নাশেফ ভিডিওগুলিতে থাকা শিক্ষনীয় গুণাবলীর প্রশংসা করেন, কিন্তু তার স্ত্রী মনে করেন বেবি শার্ক ‘বাচ্চাদের জন্য খুব বেশি উদ্দীপক’।
তবুও এমন ভাইরাল ভিডিও স্পষ্টতই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ তাদের তিন বছর বয়স পূর্ণ করতে যাওয়া মেয়েটির জন্য আয়োজিত হতে যাচ্ছে বেবি শার্ক-থিমযুক্ত জন্মদিনের পার্টি।
কিম মিন বলেন, পিঙ্কফং বেবি শার্কের বাণিজ্যিক আবেদনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্যান্য চরিত্র তৈরি করতে পারবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এটি তার শেয়ার বাজারে আত্মপ্রকাশের সময় প্রায় ৫২ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে এবং এই অর্থ ব্যবহার করে তারা তাদের চলচ্চিত্র আর চরিত্রগুলি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে, বলেন কিম মিন।
কনটেন্ট দেখার প্রবণতা এবং অন্যান্য ডেটা ব্যবহার করে নতুন প্রকল্পগুলিকে রূপ দিতে একটি ‘প্রযুক্তি-চালিত’ কন্টেন্ট নির্মাতা হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে কোম্পানিটির।
পিঙ্কফং ইতিমধ্যেই ‘অনেক নির্মাতারা সবসময় যে স্বপ্ন দেখেছেন’ তা অর্জন করেছে, বলেন কিম মিন।
কিন্তু এখন তাদের এটি বিনিয়োগকারীদেরকে বোঝাতে হবে যে পিঙ্কফং কেবল একবারের জন্য হিট কনটেন্ট প্রস্তুতকারী কোনো বিস্ময় নয়। তথ্যসূত্র-বিবিসি
এমবি

