Logo

অর্থনীতি

তালিকাভুক্ত ৮ এনবিএফআই বন্ধে বিনিয়োগকারীর ক্ষতি ৯৪৭ কোটি!

Icon

এম এম হাসান

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৮

তালিকাভুক্ত ৮ এনবিএফআই বন্ধে বিনিয়োগকারীর ক্ষতি ৯৪৭ কোটি!

আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির কারণে সম্প্রতি নয়টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) অবসায়ন বা বন্ধের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আটটি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। যেগুলোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর মালিকানা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হলে বিনিয়োগকারীর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৪৭ কোটি টাকা। যদিও এখনো পুঁজিবাজারে কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। বাজারদর বিবেচনায় নিলেও বিনিয়োগকারীরা ১০০ কোটি টাকার বেশি দাবিদার। তা শর্তেও তাদের ভাগ্যে কিছুই জুটছে না।

অল্প কয়েকদিন আগেই পাঁচটি দুর্বল শরিয়াহ ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসেই ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসির’ নামে এই ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। ওই পাঁচটি ব্যাংকও দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। সরকার একীভূত হওয়া এই ব্যাংকটির দায়িত্ব নিয়ে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়েছে। তবে, বিনিয়োগকারীদের বিষয়টি চূড়ান্ত না করেই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর শেয়ার লেনদেনও বন্ধ রয়েছে। হতাশাগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা তাদের হিস্যা বুঝে পেতে আন্দোলন করলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় সরকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ধের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হলো। এ বিষয়গুলো পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। 

এনবিএফআই বন্ধ হলে বিনিয়োগকারীদের সম্ভাবনা কতটা: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত আগস্টে জানান, আর্থিক অবস্থার চরম অবনতির কারণে নয়টি এনবিএফআইয়ের লাইসেন্স বাতিল করে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ বা অবসায়নে পাঠানো হবে। এর মধ্যে আটটিই দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত- পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি ও প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। 

তালিকাভুক্তির তথ্য অনুযায়ী, এই আট প্রতিষ্ঠানের মোট পরিশোধিত মূলধন প্রায় এক হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর দুই-তৃতীয়াংশ বা প্রায় ৯৪৭ কোটি টাকার শেয়ার ধরে আছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হলে এ অর্থের পুরোপুরিই হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।

সর্বশেষ প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিগুলোর মধ্যে সাতটির শেয়ারপ্রতি নেট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি) ঋণাত্মক রয়েছে, যা গড় হিসেবে ঋণাত্মক ৯৫ টাকা। অর্থাৎ এনবিএফআইগুলোর দায়দেনা তাদের সম্পদের চেয়েও অনেক বেশি। অবসায়ন প্রক্রিয়া অনুযায়ী, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দাবি পূরণের বিষয়টি থাকে সর্বশেষ ধাপে। সে হিসেবে প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা সধারণ বিনিয়োগকারীদের হিস্যা বুঝে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই সামান্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু এই আট এনবিএফআইয়ের কাছেই রয়েছে খাতটির মোট খেলাপি ঋণের ৫২ শতাংশ। ২০টি প্রতিষ্ঠানকে লাল-শ্রেণিভুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাখ্যা তলব করেছিল। এর মধ্যে এই নয়টি প্রতিষ্ঠান সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হয়।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর হতাশা: পিপলস লিজিংয়ের একজন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী রনি হায়দার জানান, শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা দরে প্রতিষ্ঠানটির কয়েক হাজার শেয়ার কিনেছিলেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানটি পুনরুদ্ধারের আশায় তিনি শেয়ার কিনেছিলেন।

তিনি ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘সরকার কিছু ব্যাংককে বাঁচিয়েছে, তাই ভেবেছিলাম এনবিএফআইয়ের ক্ষেত্রেও কোনো না কোনো সমাধান হবে। কিন্তু কোনো সহায়তা এল না।’

দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার ফল: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বছরের পর বছর অনিয়ম, তদারকির দুর্বলতা আর অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা বহু আগে সতর্ক করেছিলাম- ব্যাংক ও এনবিএফআইগুলো থেকে টাকা বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, সাধারণ বিনিয়োগকারী না বুঝেই এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন যে এসব প্রতিষ্ঠানের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অথচ, সাধারণ বিনিয়োগকারী যদি কিছুই না পায় তাহলে পুঁজিবাজারে তার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও একই চিত্র। আমরা চাই- সরকার মানবিক দৃষ্টিতে বিনিয়োগকারীদের বিষয়টি দেখুক।’

বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা কে দেবে: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একটি সূত্র জানিয়েছে, তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় সরকারকে অনুরোধ জানানো হতে পারে। তবে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বিএসইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের সিদ্ধান্তের আগে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয় না। ফলে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিতে পড়ার আগেই প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ থাকে না।’

এর আগে পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির ব্যাপারে বিএসইসির অনুরোধ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিবেচনায় নেয়নি বলেও জানায় ওই কর্মকর্তা।

এনবিএফআইগুলো বাঁচানো যেত কি: সিএফএ সোসাইটির সভাপতি আসিফ খান বলেন, ‘যে এনবিএফআইগুলো বহু বছর ধরে আমানত ফেরত দিতে পারছে না, সেগুলো কার্যত দেউলিয়া। এতে বিনিয়োগকারীদের কিছু পাওয়ার সুযোগ নেই। আগে আমানতকারীদের পাওনা মিটবে। তারপর বিনিয়োগকারীদের বিষয়টি দেখা হবে।’

তিনি মনে করেন, ‘ভুল তথ্য প্রকাশ, দুর্বল তদারকি ও দায়হীনতার সংস্কৃতি বন্ধ না হলে ভবিষ্যতেও এই খাতে একই সংকট তৈরি হবে।’

একজন শীর্ষ এনবিএফআইয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা বাজার ঝুঁকি নেন ঠিকই, কিন্তু তাদের পুরো ক্ষতির বড় অংশ এসেছে দুর্নীতি আর দুর্ব্যবস্থাপনার কারণে। অথচ, শুধু ব্যাংকের ক্ষেত্রে সরকার দায়িত্ব নেবে,  আর এনবিএফআইগুলোর ক্ষেত্রে নেবে না- এটা ন্যায়সংগত নয়।’ এ বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কোনো মন্তব্য দেননি।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ ব্যাংক

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর