গরিব শিক্ষার্থীদের টাকায় ‘শিক্ষক কল্যাণ তহবিল’
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:৪৪
-68ceafc591827.jpg)
- প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আদায় হচ্ছে ১৮৩ টাকা
- ১০০ টাকা যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ তহবিলে
- যদিও তহবিলে সরকারের বরাদ্দ ২২০০ কোটি টাকা
- ৭২৯ সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে
- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা অবৈতনিক শিক্ষানীতির লঙ্ঘন
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আবারও সামনে এসেছে একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, যা রাষ্ট্রীয় শিক্ষা নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে সারাদেশের ৭২৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গরিব, অসহায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন ফি হিসেবে ১৮৩ টাকা আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ১০০ টাকাই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলের জন্য নির্ধারিত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত সরকারের ‘বিনামূল্যে শিক্ষা’ নীতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং শিক্ষাকে পণ্যরূপে পরিণত করার অযৌক্তিক প্রয়াস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্র যখন শিক্ষাকে ‘অবৈতনিক ও সবার জন্য অধিকার’ ঘোষণা করে, তখন সেই একই রাষ্ট্রের একটি সিদ্ধান্ত যখন গরিব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা হারে ‘চাঁদা’ আদায় করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণে খরচ করতে চায়, তখন প্রশ্ন ওঠে— এ কি নতুন ধরনের শিক্ষা-শোষণ?
সম্প্রতি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জারি করা এক জরুরি বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে সারাদেশের ৭২৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮৩ টাকা। এর মধ্যে ৮৩ টাকা বোর্ড ফি, আর বাকি ১০০ টাকা বেসরকারি অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলের জন্য।
তবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা বলছেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যাদের পরিবার প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খায়। এমন পরিস্থিতিতে ১০০ টাকার বোঝা চাপানো মানে শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, এসব শিক্ষার্থীরা সাধারণত দরিদ্র পরিবার থেকেই আসে, যাদের পক্ষে এমন আর্থিক বোঝা বহন করা প্রায় অসম্ভব। একদিকে রাষ্ট্র ‘অবৈতনিক শিক্ষা’র কথা বলছে, অন্যদিকে আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকা সত্ত্বেও তাদের থেকে ১০০ টাকা চাচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এই ১০০ টাকা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর ও কল্যাণ তহবিলের জন্য ধার্য করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার যখন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য ইতিমধ্যেই ২২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, তখন গরিব অসহায় শিক্ষার্থীদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় কেন?
শিক্ষকরা বলছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল নীতি হচ্ছে ‘বিনামূল্যে শিক্ষা ও সমান অধিকার।’ অথচ সকল শিক্ষার্থীর জন্যই ১০০ টাকা নির্ধারিত করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ তহবিলের জন্য মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার কোটি ‘অবসর সুবিধা বোর্ডে’ এবং ২০০ কোটি ‘কল্যাণ ট্রাস্টে’ রাখা হবে। এই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকবে এবং ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হবে। এর সুদ থেকেই শিক্ষকদের জন্য ভবিষ্যৎ পেমেন্ট নিশ্চিত করা হবে। এমন বাস্তবতায় শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘যেখানে সরকারি কোষাগার থেকে এত বিশাল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কাঁধে ১০০ টাকা চাপানো রাষ্ট্রীয় অন্যায়।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সরকারের বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত। একদিকে সরকার অবৈতনিক শিক্ষার কথা বলছে, অন্যদিকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অন্যদের কল্যাণের জন্য অর্থ আদায় করছে। এটি এক ধরনের নৈতিক দ্বিচারিতা। রাষ্ট্র নিজের আদর্শের সঙ্গেই প্রতারণা করছে।
বেসরকারি শিক্ষক নেতারা সরকারকে ধন্যবাদ জানালেও, তারা কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেননি— কিভাবে এই অর্থ সংগ্রহ হবে এবং কেন গরিব শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো হবে। তবে তারা বলছেন, ‘আমাদের শিক্ষকরা অবসরে গিয়ে কষ্ট পান, তাই এই বরাদ্দ সময়োপযোগী।’
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ঢাকার শেখদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহসান উল্লাহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের দপ্তরে একটি আবেদন করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, গরিব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা আদায় একটি চরম বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত, যা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংসের কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘এটা একবার চালু হলে বন্ধ হবে না, বরং পরবর্তী বছরগুলিতে আরও বেশি চাপ পড়বে।’
ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত দেশের লাখো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ‘অবৈতনিক শিক্ষার’ স্বপ্নকে অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবিরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব রেহেনা পারভীনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এমএইচএস