শিক্ষকের আলোয় আলোকিত জীবন
প্রান্তিক গ্রাম থেকে লন্ডন পর্যন্ত তাঁর শিক্ষার্থীদের পদচারণা
বাগেরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫১
দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে যাদের হাতে, তারা অনেক সময় আলোয় আসে না। কিন্তু তাদের ছোঁয়ায় আলোকিত হয় অসংখ্য জীবন। গাজী মোহাম্মদ আলী এমনই একজন শিক্ষক, যিনি প্রান্তিক গ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে হাজারো শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলেছেন। তিনি রামপালের ২১ চাকশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
বানতলা ইউনিয়নের বারুইপাড়া গ্রামে ১৯৬৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন গাজী মোহাম্মদ আলী। শৈশব থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো জ্ঞান। এই বিশ্বাস তাকে নিয়ে যায় শিক্ষকতার পথে।
১৯৮৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর মল্লিকের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে দুর্গাপুর, পশ্চিম গোবিন্দপুর, গোবিন্দপুর, ফয়লার হাটসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন।
গাজী মোহাম্মদ আলীর শিক্ষাদর্শন ছিল আলাদা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক সবসময় আত্মার। তিনি কেবল পাঠ্যবই পড়াতেন না- শিখাতেন বাঁচতে, স্বপ্ন দেখতে।
২০০০ সালে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পান এবং প্রসাদনগর ভৈরবডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। ২০০১ সালে তিনি রামপালের ২১ চাকশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেই থেকে ২৫ বছর ধরে তিনি স্কুলটিকে একটি পরিবারে পরিণত করেছেন।
তার শিক্ষার্থীরা আজ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। ময়মনসিংহ মেডিকেলের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নাইমা আফরোজ শিমু বলেন, ‘স্যার শুধু বই পড়া শেখাননি, মানুষ হতে শিখিয়েছেন। তাঁর অনুপ্রেরণা না থাকলে আমি ডাক্তার হতে পারতাম না।’
চাকশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমাতুল জোহরা বলেন, ‘আমি স্যারেরই ছাত্রী ছিলাম। এখন তাঁর সঙ্গে একই স্কুলে শিক্ষকতা করি- এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’
লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ছেন শেখ আবুল বাশার বলেন, ‘আমার জীবনের ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিলেন গাজী মোহাম্মদ আলী স্যার। প্রতিটি অর্জনের পেছনে তাঁর শিক্ষাই কাজ করছে।’
৩৮ বছরের দীর্ঘ পথচলায় গাজী মোহাম্মদ আলী পেয়েছেন দুই শতাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তবে তাঁর চোখে আসল পুরস্কার হলো শিক্ষার্থীদের সাফল্য। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা হলো জীবনের ভিত্তি। এখান থেকেই মানুষ গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা দেশ ও বিদেশে ডাক্তার, প্রকৌশলী বা শিক্ষক- এটাই আমার সার্থকতা। আমরা শিক্ষকরা চাইলে পৃথিবীটাকে আলোকিত করে তুলতে পারি।’
চাকশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে বোঝা যায়, গাজী মোহাম্মদ আলী কেবল প্রধান শিক্ষক নন, তিনি একজন পরিবারের কর্তা। শিক্ষার্থীদের ছোট ভুলেও তিনি রাগ করেন না, বরং তাদের বোঝান। তার কাছে শিক্ষা মানে জীবনচর্চা।
সহকর্মীরা জানান, তিনি অফিসে আসেন সবার আগে, যান সবার শেষে। কোনো শিক্ষক বা শিক্ষার্থী বিপদে পড়লে তিনি সবার আগে পাশে দাঁড়ান।
বুয়েট, কুয়েট, ঢাবি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়- দেশের প্রায় সব শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে এখন তাঁর প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা রয়েছে। যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কানাডাতেও তার ছাত্রছাত্রীরা কাজ করছেন। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে যাঁরা শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ী হয়েছেন, তারা প্রমাণ করছেন গাজী মোহাম্মদ আলীর শিক্ষার আলো কতটা বিস্তৃত।
২০২৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৩৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানবেন গাজী মোহাম্মদ আলী। তবে তাঁর রেখে যাওয়া আলোর রেখা থেকে যাবে অসংখ্য মানুষের জীবনে। সহকর্মী শেখ শরিফুল ইসলাম বলেন, “স্যার আমাদের শুধু শিক্ষক নন, তিনি একজন প্রতিষ্ঠান। তাঁর মতো মানুষ প্রমাণ করেন- একজন প্রাথমিক শিক্ষকও পুরো সমাজ বদলে দিতে পারেন।”
গাজী মোহাম্মদ আলীর জীবন কেবল পেশাগত সাফল্যের কাহিনি নয়, এটি ত্যাগ, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের ইতিহাস। আজকের শিক্ষক দিবসে তাকে সম্মান জানানো মানে সেই সকল শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা- যারা নীরবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন।
শেখ আবু তালেব/আইএইচ

