
সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সুশিক্ষিত দল-গোষ্ঠী আগামীর ভবিষ্যৎ। সুশিক্ষাই একমাত্র উন্নতির সোপান। দেশ ও জাতিকে সুন্দর করে গঠন করতে সুশিক্ষা-সংস্কৃতির বিকল্প নেই। সুশিক্ষা বলতে মাদরাসা শিক্ষা। এ মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস প্রাচীন থেকে প্রাচীনতম। অনেক পুরোনো দিনের কথা। পৃথিবীর বয়স যত দিন, শিক্ষার বয়স তত দিন। সভ্যতার বয়স যত দিন, সংস্কৃতির বয়সও তত দিন। আল্লাহ তাআলা স্বভাবগত মানুষকে একজন জ্ঞানী খলিফা করে পাঠিয়েছেন। অতঃপর কুরআনুল কারিমে এরশাদ করেছেন, পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা: আলাকু, আয়াত-১)
আদর্শ সৌন্দর্যপূর্ণ ব্যক্তি, দল, সমাজ গঠনে ইসলামী শিক্ষা তথা মাদরাসা শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, মাদরাসা শিক্ষার বড় অবদান হলো সৎ ও আদর্শ বাস্তবায়ন করা। মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকরা অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকে। মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা জুমার খুতবা, ওয়াজ মাহফিল, সভা-সেমিনার ও ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সৎভাবে জীবনযাপন করার উপদেশ দেন। তাঁদের উপদেশ শুনে সাধারণ মানুষ সৎভাবে জীবনযাপন করার চেষ্টা করেন। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি মাদরাসাগুলো অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান ও অসহায় এতিম শিশুদের বিত্তবানদের সহযোগিতায় নিরক্ষরতা দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। অতএব, সৎ ও আদর্শ জাতি গঠনে মাদরাসা শিক্ষার ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ, এ শিক্ষা শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিকশিত মুক্ত-সচেতন মানবসত্তাকে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উন্নত যোগসূত্র রচনা করার। এ শিক্ষা চেতনাকে বিশুদ্ধ করার।
এ শিক্ষার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া হলো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত এবং ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধীয় পরিবেশ। দ্বীনি শিক্ষা অর্থাৎ মাদরাসা শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা। এর মাধ্যমে সুশৃঙ্খল অনুসরণীয় একদল মানবের আবিষ্কার হবে যারা পরস্পরে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। যারা নৈতিক সংস্কৃতি চর্চা করবে। যারা সমাজ বিনির্মাণ করবে। এ জন্যই শিক্ষার মূল্যায়ণ সম্পর্কে আল্লামা ইকবাল বলেন "রুহের উন্নয়ন ঘটানোর প্রক্রিয়ার নামই শিক্ষা"।
এক, কওম শব্দের অর্থ জাতি, মাদরাসা শব্দের অর্থ বিদ্যালয়, সংযুক্ত কওমি মাদরাসার অর্থ হলো জাতীয় বিদ্যালয়। পরিভাষায় এভাবে বলতে পারি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ, মূলনীতি ও মতপথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তায় উলামাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহির শিক্ষাকেন্দ্র।
আল্লাহ তাআলা হজরত আদম আ. কে সৃষ্টি করে শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নবী ও রাসুলগণকে আসমানী কিতাবের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। সর্বশেষে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কুরআন মজিদ নাজিল করে শিক্ষা দিয়েছেন। অতঃপর প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহির শিক্ষা সাহাবিদের মধ্যে বিতরণ শুরু করেন। নবী-রাসূলগণের এ কাজ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন বা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের মানদণ্ড সম্পর্কে মানুষকে পড়ে শুনান। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেন আর শিক্ষা দেন জীবনযাপনের কৌশল। অথচ এর পূর্বে তারা ছিল সুস্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত। (সূরা: জুমআ, আয়াত- ২)
আল্লাহ প্রদত্ত রাসুলের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনন্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন একটি বর্বর ও অশিক্ষিত জাতিকে। তৈরি করেছেন সুশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খলিত সর্বোত্তম সঙ্গী। কালোকে রূপান্তরিত করেছেন আলোতে। যারা হয়েছেন আল্লাহর প্রিয়। তাঁদের শিক্ষা কেন্দ্র বা পাঠশালা ছিল 'সুফফা' যা মসজিদে নববীতে অবস্থিত। আর এটিই হলো নবুয়তের পর ইসলামের প্রথম মাদরাসা। এই মাদরাসায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন প্রথম শিক্ষক। সাহাবীগণ ছিলেন প্রথম ছাত্র। এখান থেকে উম্মতে মোহাম্মদীর শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। এভাবে খোলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং শিক্ষাব্যবস্থা একটি পরিপূর্ণতা লাভ করে।
অতঃপর ১৮৬৬ সালের ৩০ মে হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) প্রতিষ্ঠা করেন 'দারুল উলুম দেওবন্দ' মাদরাসা। সেই দারুল উলুম দেওবন্দে পুনরায় যে শিক্ষার মশাল প্রজ্বলিত করা হয়েছিল তারই উত্তরাধিকার বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাসমূহ। এ শিক্ষা মহান আল্লাহ প্রদত্ত মূলধারার শিক্ষা, স্রষ্টার আনুগত্য ও সৃষ্টির সেবায়
নিবেদিত মানুষ তৈরির শিক্ষা। এ শিক্ষা একটি ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা। দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের মুক্তি নির্দেশক শিক্ষা। এ শিক্ষার মধ্যে মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিদায়েত প্রাপ্তি ঘটে। সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা সৌহার্দ-সম্প্রীতি রক্ষার সকল উপাদান এ শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই আদর্শ সমাজ গঠনে কওমি মাদরাসা দেশে কার্যকর ও ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে।
দুই, কওমি শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। লক্ষ্য হচ্ছে সুনাগরিক তৈরি করা। মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। মানুষের মস্তিষ্কে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধন করা। মানুষকে আল্লাহর অনুগত ও রাসুল (সা.)-এর অনুসারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এতেই ক্ষান্ত নয়, বরং উন্নয়ন-উৎপাদনে এ শিক্ষার গৌরবজনক অংশীদারত্ব রয়েছে। দেশের ভেতরে কোনো আলেম বেকার নন। লক্ষ লক্ষ আলেম কর্মব্যস্ত কল্যাণমুখী মহৎ জীবন অতিবাহিত করছেন। সকলেই কোনো না কোনো মহৎ কাজে উন্নয়ন-উৎপাদনে অবদান রেখে চলেছেন। তাকিয়ে দেখুন, বাংলাদেশসহ প্রায় সারা দুনিয়া এমনকি সৌদি আরব পর্যন্ত বাংলাদেশের হাজার হাজার আলেম ইমাম ও মুয়াজ্জিন হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং বলা চলে, উন্নয়ন-উৎপাদনে তাঁদের ভূমিকাও যথার্থ।
তিন, কওমি মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কওমি মাদরাসার বিকল্প নেই। কেননা এখানে সর্বজনীন আদর্শ, চেতনা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে ব্যক্তি গঠন করা হয়। নৈতিকতা ও সামাজিক শিষ্টাচারের পরিশীলিত পাঠ পেয়ে সকলেই সুনাগরিকে পরিণত হয়। গড়ে ওঠে সমাজের আদর্শিক নেতৃত্বদানের যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে। এখান থেকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে ছড়িয়ে পড়ছে ঐশী নূরের পবিত্র ঝর্ণাধারা। এতে অবগাহন করে দিন-রাত উপকৃত হচ্ছে সমাজের প্রতিটি মানুষ। উপকৃত হওয়ার এই ধারাবাহিকতা চলছে জীবনের প্রতিটি ধাপে। জন্মের পূর্ব থেকে মৃত্যুর পর পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা চলে।
গর্ভকালীন নানা সমস্যার শরয়ী সমাধান, জন্মের পর সুন্দর নাম রাখা, আকিকা করা ও বিবাহ শাদীসহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনে কওমি মাদরাসার আলেমের প্রয়োজন পড়ে। মুমূর্ষু ব্যক্তির জন্য দোয়া, জানাজার নামাজ, কাফন-দাফন ও ঈসালে সওয়াবের কথা আলেম ব্যতীত কল্পনাও করা যায় না। সহীহ আকিদা, সব ধরনের ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাতসহ যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা সমস্যার শরয়ী সমাধানের লক্ষ্যে মানুষ ছুটে আসে কওমি মাদরাসায়। এটাকে তাদের সর্বশেষ ভরসাস্থল মনে করে। আলেমদের সান্নিধ্য ও দীনের সঠিক পথে চালিত হওয়ার মাধ্যমে বদলাতে থাকে সমাজের মানুষ। ভ্রাতৃত্বের ছায়ায় একসময় গড়ে ওঠে আদর্শ সমাজ। যার নেপথ্য শক্তি এই কওমি মাদরাসা।
তাই তাদের নেতৃত্বেই ধীরে ধীরে ধর্মীয় বলয়ে গঠিত হয় আদর্শ সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থা। এর অন্যতম কারণ, সমাজ ও সমাজের মানুষের সঙ্গে কওমি মাদরাসাগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সরকারি অনুদান নয়, বরং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় তা চালিত হয়। সমাজের সবচেয়ে নিরাপদ ও আস্থার জায়গা এটি। এখান থেকে গ্রাজুয়েট করা মানুষগুলো চারিত্রি-নৈতিকতার শীর্ষে অবস্থান করেন। তাদের দুচোখে খেলা করে আখেরাতের অনিন্দময় জীবনের স্বপ্ন। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেদের গা ভাসিয়ে দেন না।
আবার হ্যা, কওমি মাদরাসার দেড় শ বছরের ইতিহাস সাক্ষী, এখানে পড়তে এসে কারো সঙ্গে কোনো বিবাদে জড়িয়ে কিংবা প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার বলি হয়ে কাউকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়নি। কখনো বেজে উঠেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, শেয়ার কেলেংকারীসহ সব ধরনের চারিত্রিক কলঙ্ক থেকে তারা মুক্ত। এ জন্য বলা হয়, বিশুদ্ধ চেতনার ইশতেহার 'কওমি মাদরাসা'।
সর্বোপরি আমাদের উচিত মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানো। কেননা, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামী শিক্ষা ছাড়া প্রকৃত অর্থে মানুষ হওয়া কষ্টসাধ্য। এজন্য ঈমানের পরে ইলমই হলো আল্লাহর নিকট মর্যাদা বৃদ্ধির প্রথম উপায়। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের ইলম বা জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে তাদের মর্যাদা আল্লাহ বাড়িয়ে দেবেন (সুরা: মুজাদালা, আয়াত- ১১)
অতএব, সন্তানকে পরিপূর্ণ ইসলামী শিক্ষাদানের যথাযথ ব্যবস্থা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। আপনার সন্তান হবে দেওবন্দের সূর্যসন্তান। এটা একটি নবুয়তি কাজের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ আমাদের সকলকে সহীহ ইলম শিক্ষা করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, ইমাম ও খতিব, কুষ্টিয়া
আইএইচ/