কওমি মাদরাসা : নববী ইলমের প্রকৃত ক্ষেত্র ও আত্মোৎসর্গের শিক্ষা

মো. জাহাঙ্গীর হুসাইন
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:০৯

ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা যুগে যুগে নানা ধারায় বিকশিত হয়েছে। কারও কাছে ইসলামি শিক্ষা মানে কেবল ধর্মীয় রীতি-নীতি জানা, কারও কাছে আবার আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সমন্বয়। কিন্তু ইসলামি শিক্ষার গভীরতম ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি যাকে বলা হয় নববী ইলম, সেই জ্ঞানের প্রকৃত কেন্দ্র আজও কওমি মাদরাসাই। এই শিক্ষা শুধু একটি পাঠ্যধারা নয়- এটি এক জীবনের অনুশীলন, আত্মোৎসর্গের বিদ্যালয়, এক নিরন্তর সাধনা।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে কওমি ধারার ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। উপনিবেশিক যুগে ধর্মীয় মূল্যবোধ, আত্মপরিচয় ও সমাজের আধ্যাত্মিক ভিত্তি রক্ষার প্রয়োজনে যে ধারাটি গড়ে ওঠে, তা সময়ের পরিক্রমায় আজ বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের আস্থার প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। বহুধারা শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরেও কওমি মাদরাসা তার মৌলিক নীতি, আমল ও আখলাকের কারণে নিজস্ব মর্যাদা ধরে রেখেছে।
কওমি মাদরাসার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- এ শিক্ষাব্যবস্থা দুনিয়াবি লাভ বা উপার্জনের জন্য পরিচালিত নয়। এখানকার ছাত্র-শিক্ষকরা নিজেদের জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নববী আদর্শে উৎসর্গ করেন। কওমি ধারার একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবনের শুরুতেই বুঝে নেয়- এ পথ সহজ নয়। এখানে আরাম নেই, ভোগ নেই; আছে ত্যাগ, ধৈর্য, কষ্ট ও আত্মসংযম।
একজন কওমি ছাত্রের দিন শুরু হয় মসজিদের আজান দিয়ে, আর শেষ হয় রাত্রি গভীরে কিতাব অধ্যয়ন করে। শিক্ষকগণও এই ত্যাগের ধারায় নিজেদের ঢেলে দেন- নীরবে, নিঃস্বার্থভাবে, বিনিময়ের প্রত্যাশা ছাড়াই। তাদের শিক্ষাদান কেবল পেশা নয়, বরং ইবাদতের এক রূপ। ফলে কওমি মাদরাসায় শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতা, বিনয়, আমল ও চরিত্রগঠন স্বাভাবিকভাবে মিশে যায়।
ইলমে দ্বীন বা ধর্মীয় জ্ঞান ইসলামি সভ্যতার মেরুদÐ। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য পথে বের হয়, তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ হয়ে যায়।” কওমি মাদরাসাগুলো এই নববী আদর্শকেই বাস্তবায়িত করে চলেছে। এখানে জ্ঞান মানে শুধু কিতাব পড়া নয়- বরং আল্লাহর সৃষ্টি, মানবতা, ন্যায়বিচার ও আখলাকের গভীর উপলব্ধি অর্জন করা।
ফলে কওমি শিক্ষার প্রভাব শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও গভীর। গ্রামবাংলার মসজিদ, মক্তব, হালকা বা ধর্মীয় সমাবেশ- সর্বত্র কওমি শিক্ষিত আলেমদের নেতৃত্ব ও উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। তারা সমাজে নৈতিকতার বার্তা ছড়িয়ে দেন, মানুষকে সৎপথে আহŸান করেন, অনৈতিকতা ও বিভ্রান্তি থেকে দূরে রাখেন।
বর্তমান সময়ে এক শ্রেণির মানুষের ধারণা- কওমি শিক্ষা আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। বাস্তবে এটি একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি। কওমি মাদরাসাগুলোর অনেক প্রতিষ্ঠান এখন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, গবেষণা ও ভাষা শিক্ষার সংযোজন ঘটিয়েছে। ইসলামের মূল মূল্যবোধ বজায় রেখে আধুনিক জ্ঞানকে গ্রহণ করাই এখন তাদের নতুন প্রয়াস।
আসলে কওমি শিক্ষার লক্ষ্য কখনোই আধুনিক জ্ঞানের বিরোধিতা নয়; বরং দুনিয়াবি শিক্ষার মাঝে আত্মিকতা ও নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপন করাই এর উদ্দেশ্য। আধুনিক বিশ্বে জ্ঞানকে ‘উপকরণ’ হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু কওমি ধারা শেখায়- জ্ঞান হলো অমানত। এর ব্যবহারও হতে হবে নৈতিক ও আল্লাহভীতির ওপর ভিত্তি করে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কবি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, হেমায়েতপুর, সাভার, ঢাকা