Logo

শিক্ষা

বিশেষ সাক্ষাৎকার

কওমি মাদরাসা বেকার লোকবল তৈরি করে না

মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া

ইনজামামুল হক

ইনজামামুল হক

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২৩

কওমি মাদরাসা বেকার লোকবল তৈরি করে না

বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ স্থাপনে এসব মাদরাসার অবস্থান অনস্বীকার্য। তবে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সরকারি সনদের স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রায় এক দশক পার হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি এখনও। বরং পদে পদে তারা নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। সরকারি সনদের মূল্যায়ন, বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ ও কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)-এর সহসভাপতি মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়ার একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ‘বাংলাদেশের খবর’-এর সহসম্পাদক কাজী ইনজামামুল হক। 

বাংলাদেশের খবর : কওমি সনদের মানোন্নয়নে বেফাক ও হাইয়্যাতুল উলিয়া কী পরিকল্পনা নিয়েছে?

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : বেফাক, হাইয়্যা যেভাবে এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া দরকার সেভাবে অগ্রসর হচ্ছে। কওমি শিক্ষার স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য যেন অক্ষুন্ন থাকে, সে বিষয়টি বেফাক এবং হাইয়্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিবেচনায় রাখছে। যদি তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় না রাখা হয়, তাহলে দেখা যাবে কওমি মাদরাসার নাম থাকবে, কিন্তু শিক্ষা থাকবে না। আর এমন কিছু দায়িত্বশীলরা কখনোই হতে দিবে না।

বাংলাদেশের খবর : কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ভবিষ্যতে এর সঠিক মূল্যায়নের সম্ভাবনা আছে কি?

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : এসব বিষয় সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে আমরা আশাহত নই।

বাংলাদেশের খবর : বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী কওমি মাদরাসায় পড়ছে। অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি কওমিদের জাগতিক শিক্ষায়ও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : মাদ্রাসায় জাগতিক শিক্ষা একেবারেই দেওয়া হয় না, এমন কথা সঠিক নয়। বরং শিক্ষার বিভিন্ন ধারা আছে। এর একটি হলো মাদরাসা শিক্ষা। মাদরাসায় কোরআন, হাদীস, ফেকাহ, দর্শন ইত্যাদি শাস্ত্র নিবিড়ভাবে পড়ানো হয় এবং সেখানে কোরআন, হাদিসের বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়।

আর হ্যাঁ! সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে ধর্মীয় সেক্টরে যে চাহিদা রয়েছে এখন পর্যন্ত সে চাহিদা পূরণ  করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কেন হয়ে ওঠেনি? এ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে লম্বা হয়ে যাবে। তাই সেদিকে যেতে চাচ্ছি না। বরং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে জোরালভাবে যে দাবি আমাদের উঠানো উচিত, তা হলো- জাগতিক শিক্ষায় প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। কিন্তু সে দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল মাদরাসা শিক্ষায় জাগতিক শিক্ষার প্রবেশ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, মাদরাসা শিক্ষাকে বিতর্কিত করে রাখা।

বাংলাদেশের খবর : বিদেশে, বিশেষ করে মিশরে কওমি সনদের মূল্যায়ন না পাওয়াটা কতটা বেদনাদায়ক?

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : দেখুন! এ নিয়ে কথা বলতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলা যায় না। এটা মূল্যায়নের চেয়ে বেশি প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক অনুমোদন, স্বীকৃতি। সেটি হলে অনেকটাই সহজ হত।

বাংলাদেশের খবর : অনেক কওমি শিক্ষার্থীর স্বপ্ন দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়ন করার। কিন্তু এখনো সেই সুযোগ নেই কেন?

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : আপনি অবশ্যই বাস্তব কথা বলেছেন। দারুল উলুম দেওবন্দ হল আমাদের চেতনা, আদর্শের বাতিঘর। সকলেরই স্বপ্ন দেওবন্দে পড়ার। এ সুযোগ আগে ছিল। ভারত সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণে তা বন্ধ হয়ে যায়। উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেওবন্দে পড়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভারত তো বাংলাদেশের ব্যাপারে আধিপত্যবাদী নীতি গ্রহণ করে থাকে। তবে আমাদের পক্ষ থেকেও চেষ্টা যে একেবারেই করা হয়নি, তা নয়। কিন্তু তাদের থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশের খবর : পাকিস্তানে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা ভিসা ও ইমিগ্রেশন জটিলতায় পড়ছেন- এ ব্যাপারে বেফাক বা হাইয়্যা কি পদক্ষেপ নিচ্ছে?

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : পাকিস্তানে একসময় স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়া যেত। বহু শিক্ষার্থীরা সেখানে লেখাপড়া করতে যেত। ওয়ান ইলেভেনের পর বৈশ্বিক রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। ফলে সাদা হয়ে যায় কালো, আর কালো হয়ে যায় সাদা। যার কারণে পাকিস্তানে শুধু বাংলাদেশীদের নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্টুডেন্ট ভিসাও বন্ধ হয়ে যায়।

আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর পাকিস্তানে স্টুডেন্ট ভিসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সে সুযোগে কিছু ছাত্র সেখানে ভিসা নিয়ে পড়তেও যায়। এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়নি। স্টুডেন্ট ভিসা তো আরো জটিল বিষয়। আগে উভয় দেশের সম্পর্ক একটা স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে হবে। তারপর এসব বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে একটা পর্যায়ে পৌঁছানো যাবে।

বাংলাদেশের খবর : কওমি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান ও সামাজিক অভিযোজন কেমন হওয়া উচিত?

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : কওমি মাদরাসাগুলো বেকার লোকবল তৈরি করে না, বরং দায়িত্ব সচেতন আদর্শ ধার্মিক নাগরিক তৈরি করে। জীবন নির্বাহের জন্য যেকোনো বৈধ পেশা গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করে থাকে। কওমি শিক্ষার্থীরা অর্থ উপার্জনের জন্য অনৈতিক ও অন্ধকার পথ বেছে নেয় না। জীবন সংগ্রামের সর্বস্তরে নৈতিকতার সর্বোচ্চ আদর্শ প্রদর্শন যেন করতে পারে, সে চেতনা দিয়েই প্রত্যেক কওমি শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা হয়। সমাজের অন্ধকার জগতকে আলোকিত বসুন্ধরায় রূপান্তরিত করার মহান দায়িত্ব কওমি শিক্ষার্থীদের উপর রয়েছে। আর এ চেতনার সঙ্গেই তাদের তৈরি করা হয়। তারা জানে যে, ওরাসাতুল আম্বিয়া হিসেবে এ দায়িত্ব তাদের কাঁধে অর্পিত। এসবের আলোকে তারা নিজেদের কর্মপরিকল্পনা বাছাই করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের খবর : কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য আপনার গুরুত্বপূর্ণ কী উপদেশ থাকবে?

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : আল উলামায়ু ওরাসাতুল আম্বিয়া। পৃথিবীতে নবীর মিশন পরিচালনার দায়িত্ব উলামাদের অর্পিত। সে চেতনায় নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। যারা এ মিশনের সৈনিক হয় তাদের পথ কখনো মসৃণ হয় না, বরং কণ্টকাকীর্ণ হয়। তাই সে পথ মাড়িয়ে নবীওয়ালা মিশন নিয়ে চলতে হবে। ভোগ-বিলাশ, আরাম-আয়েশ দ্বারা এ মিশনের সৈনিক হওয়া যায় না।

হযরত আবু বকর (রা.)-এর বিখ্যাত উক্তি ‘আয়ানকুছুদ্দীনু ওয়া আনা হাই’ জীবনের প্রতি পদে পদে স্মরণ করতে হবে। অধর্মীয় বাতিল হোক আর ধর্মের পরিচয়ে বাতিল হোক এদের থেকে নিজেকেও রক্ষা করতে হবে, উম্মাহকেও সতর্ক করতে হবে। কেবলমাত্র মসজিদ মাদরাসায় দ্বীনের খেদমতে সীমাবদ্ধ থাকা নয়, বরং দ্বীন গোটা দুনিয়ার জন্য- এই কথাকে মেনে চলে দুনিয়াকে দ্বীনের আলোয় আলোকিত করার জিহাদে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে হবে ।

বাংলাদেশের খবর : কওমি শিক্ষকদের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে?

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষক ছিলেন। “ইন্নামা বুইসতু মুআল্লিমান” এ হাদীস দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, নবী করিম (সা.)-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল মানুষকে শিক্ষা দেওয়া- তাদেরকে আদব, ইমান, আমল ও মানবতা শেখানো। তিনি শুধু রাসুলই নন, বরং মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষকও। সে শিক্ষকের জায়গায় আপনারা রয়েছেন। সুতরাং, নবীওয়ালা মানসিকতা নিয়ে আপনাদের এ মহান দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। আপনাদের কাছে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে তাদেরকে দ্বীনের জ্ঞান দানের পাশাপাশি উত্তমরূপে পরিচর্যার মাধ্যমে দ্বীনের দাঈ, মুবাল্লিগ, মুজাহিদ, গবেষক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। তাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে, তারা যেন মাদরাসা শিক্ষা থেকে বিমূখ না হয়ে যায়। যুগ চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে। আপনাদের মনে রাখতে হবে যে, আপনার শুভাকাক্সক্ষীর তুলনায় অকল্যাণকামীর সংখ্যা কম নয়। “হেফাজতে আতফালে মুসলিমিন” তথা মুসলিম সন্তানদের সুরক্ষা আপনাদের দায়িত্বে। এ দায়িত্ববোধ মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের খবর : আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : আপনাকেও ধন্যবাদ।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর