কওমি মাদরাসার পরিচিতি : কওমি বলতে কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা, চিন্তা-চেতনা ও আদর্শকে বোঝানো হচ্ছে। ‘কওম’ অর্থ- জাতি; আর ‘মাদরাসা’ অর্থ- শিক্ষাঙ্গন বা বিদ্যালয়। ‘কওমি মাদরাসা’ এর সমন্বিত অর্থ- জাতীয় শিক্ষাঙ্গন। জাতীয় বিদ্যালয়। মুসলিম জাতির জাতীয় শিক্ষাকেন্দ্রকে কওমি মাদরাসা বলা হয়।
যে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা দেয়া হয় মুসলিম জাতির জাতীয় শিক্ষা। মুসলিম জাতির জাতীয় বিদ্বান বা পণ্ডিত আলেম-উলামা তৈরি হয়, ইসলামী জ্ঞানের ধারক-বাহক সৃষ্টি হয়, সে প্রতিষ্ঠানকেই জাতীয় বা কওমি মাদরাসা বলা হয়। এ শিক্ষাঙ্গনে মানুষকে মানুষ হওয়ার জ্ঞান বিতরণ করা হয়। যেখানে বান্দা আল্লাহ তাআলাকে পাওয়ার পথ ও পন্থা পায়। অন্যায়কে অন্যায়, ন্যায়কে ন্যায় বলতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যে শিক্ষা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইসলামের মৌলিক বিষয় তথা কোুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি জীবন ধারণ করার জন্য জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়। কোরআন-হাদিস বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আমল করার বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যে প্রতিষ্ঠানে তার নামই হলো ‘কওমি মাদরাসা’।
যে শিক্ষার পরশে মানুষ মানুষ হতে পারে; আর যার ভেতর এ বোধ তৈরি হয়- ‘সে একজন মানুষ’ তবে সে জগতের শ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিগণিত হয়। এই শ্রেষ্ঠ মানুষ যে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গড়ে উঠে, সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা বলা হয়। যে প্রতিষ্ঠানে এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে উক্ত শিক্ষাঙ্গনকে বলা হয় কওমি মাদরাসা। এ শিক্ষাব্যবস্থাই হলো ইসলামের মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থা। যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আবহমান কাল পেরিয়ে এসেছে।
ইসলামের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-আশা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কল্পনা ও বাস্তবতার রূপই হলো- কওমি ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। যুগের পরিবর্তনে কেবল অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। যেমন শিক্ষার ঘর ও আসবাব, পাঠ্যসূচির বিস্তৃতি এবং শ্রেণি বিন্যস্ততা ইত্যাদি ছাড়া অন্য কিছুই পরিবর্তন হয়নি। ইসলামের সঠিক মর্মবাণীর ধারক-বাহক এ কওমি মাদরাসার ক্রমধারা।
মোদ্দাকথা হলো, ওহির মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত যে ইলম বা জ্ঞান নবী ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসেছে, সেই ইলম বা জ্ঞান যেখানে শিক্ষা দেয়া হয় বা বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ণয় করা হয় ও বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাকেই কওমি মাদরাসা বলে।
কওমি মাদরাসার গোড়াপত্তন : কোরআনের প্রথম বাক্য। মহান আল্লাহ তাআলার সঙ্গে মুহাম্মাদ আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম আলাপন; পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রথম ফোঁটা। বান্দার কাছে আল্লাহর প্রথম হুকুম হলো- ইকরা। পড়। পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। (সুরা আলাক : আয়াত ১)
এ একটি বাক্যের মাধ্যমে ইসলামের সূচনা হয়। তপ্ত, তৃষ্ণাতুর পৃথিবীর বুকে ওহীর রহমতের বৃষ্টি পড়া শুরু হয়। আমরা এ শিক্ষাধারার আরেকটু গোড়ায় যেতে পারি। হ্যাঁ এ শিক্ষাধারার প্রথম গোড়াপত্তন হয়েছিল- হজরত আদম আ. কে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক সব নাম শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে।
আল্লাহ তাআলা বলেন- তিনি আদমকে সকল নাম শিক্ষা দিয়েছেন। (সুরা বাকারা : আয়াত ৩১) এটিই কওমি মাদরাসার প্রথম গোড়াপত্তন। শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ; আর ছাত্র মানবকূলের পিতা হজরত আদম (আ.)। এ ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে সব নবী ও রাসুল আগমন করেছেন। আল্লাহ তাদেরকে ওহির মাধ্যমে, হজরত জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। এখানে শিক্ষক মহান রব আল্লাহ তাআলা; নবী ও রাসূলগণ তার ছাত্র। এরপর নবী ও রাসূলগণ শিক্ষক হয়েছেন আর তাদের হাওয়ারীন, সাথী বা সাহাবি এবং ক্রমান্বয়ে তাঁদের উম্মতগণ ছাত্র হয়েছেন।
শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-যার পরে আর কোনো নবী আসবে না। তার মাধ্যমেই নবুওয়াতের সমাপ্তি। কোরআনই আল্লাহর শেষ পয়গাম। এরপর আর কোনো পয়গাম-কিতাব আসবে না। এই শেষ কিতাব কুরআনুল কারীম যার প্রথম কথা হলো- পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সুরা আলাক : আয়াত ১)
এ আয়াতের মাধ্যমে ইসলামের প্রথম কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অর্থাৎ মুসলমানের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। যে স্থানে প্রথম এই ওহী অবতীর্ণ হয় তার নাম হেরাগুহা। এটিই কওমি মাদরাসার প্রথম ঘর। প্রথম শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ। প্রথম ছাত্র সব মানুষের শ্রেষ্ঠ মানুষ, সব নবীর শ্রেষ্ঠ নবী, সব রাসুলের শ্রেষ্ঠ রাসুল, সব ওলির শ্রেষ্ঠ ওলি, সব সর্দারের শ্রেষ্ঠ সর্দার, সব রাহবারের শ্রেষ্ঠ রাহবার, পৃথিবীর সব দায়ীর শ্রেষ্ঠ দায়ী, দুনিয়ার সব শিক্ষকের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
শিক্ষার মৌলিকত্ব হলো- একজন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা এবং অন্যজনকে তা শিক্ষা দেয়া। রাসুলে আরাবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলা থেকে শিখতেন, সাহাবায়ে কেরাম রাযি.কে শিক্ষা দিতেন। রাসুল (সা.) মক্কায় থাকাকালীন ‘আরকাম ইবনু আবি আরকাম (রাযি.)-এর গৃহে নওমুসলিমদেরকে শিক্ষা দেয়া ও তারবিয়াত করা শুরু করেন। দারুল আরকামই হলো কওমি মাদরাসার দ্বিতীয় গোড়াপত্তন বা দ্বিতীয় শিক্ষাঙ্গন।
এরপর কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয় ‘আসহাবে সুফ্ফা’ নামে। মহানবী সা. আল্লাহ তাআলার আদেশ পেয়ে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল দিনার পার্শ্ববর্তী কুবায় পৌঁছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল মদীনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন। এ হিজরতকে ভিত্তি করেই আরবি হিজরি সনের উৎপত্তি হয়েছে। মুহাম্মদ সা. হিজরত করে আসার পর মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে মুসলমানদের শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি মাদরাসা তৈরি করেন যাকে ‘আসহাবে সুফফা’ বলা হয়। সে মাদরাসাটি ছিল মদিনার মসজিদ। মসজিদে নববী।
এখানের শিক্ষক হলেন হজরত মুহাম্মদ সা. আর ছাত্র হলেন সাহাবায়ে কেরাম রা.। শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। যার পাঠ্যবিষয় কুরআনুল কারিম ও হাদিসে নববী। সাহাবায়ে কেরাম রা. মসজিদে নববীতে এসে কোরআন-হাদিস শিখতেন ও আমল করতেন। আর হাদিসে নববী শুনতেন মুখস্থ করতেন ও আমল করতেন।
এরপর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম। ছড়িয়ে পড়ে ইলমে ওহি। ছড়িয়ে পড়ে কুরআন-হাদিস। মাদরাসা-মসজিদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হজরত উসমান রা. এর শাসন পর্যন্ত মদিনাকেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় ইলম চর্চা ছিল। তৈরি হয়েছে সাহাবায়ে কেরাম রা. মতো সর্বযুগ শ্রেষ্ঠ সোনার মানুষগণ।
হজরত আলী রাযি. যখন খলিফা নিযুক্ত হন তখন তিনি কুফায় খেলাফতের কেন্দ্র স্থানান্তর করেন। এ সময় মদিনার সঙ্গে সঙ্গে কুফাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। ইরান, ইরাক ও খোরাসানে তৈরি হয় বড় বড় শিক্ষাকেন্দ্র ও যুগ খ্যাত বড় বড় আলেম, ফকিহ, মুহাদ্দিস। ইমাম আযম আবু হানিফা রহ. এর মতো ইমাম তৈরি হয়। এরপর বোখারা, সমরকন্দ, হেরাত ও বলখে বড় বড় দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র তৈরি হয়। তৈরি হয় বড় বড় ফকিহ, মুহাদ্দিস। ইমাম বুখারি রহ. এর মতো ইমামগণ। ইসলাম বিস্তৃত হতে থাকে, বিস্তৃত হতে থাকে ইসলামী শিক্ষার গণ্ডিও। বাড়তে থাকে চাহিদা ও আয়তন।
যখন ইসলামী শিক্ষা ও আরবি শিক্ষা আরব-অনারবে প্রসার লাভ করে, তখন অনারবগণের জন্য আরবি শেখার জন্য কোরআন ও হাদিসের পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করাও আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। যথা নাহু-সরফ, বালাগাত, ইত্যাদি। তখন হজরত আলী রা.-এর নির্দেশে নাহু ও সরফ অর্থাৎ আরবি ব্যাকরণ লেখা হয়। এরপর থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা তথা কওমি শিক্ষাব্যবস্থা।
পূর্বেকার সব মাদরাসা ছিল মসজিদকেন্দ্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির ঘর ও খানকাকেন্দ্রিক। একজন মুহাদ্দিস হাদিসের দরস দিতেন। তার কাছে গিয়ে ছাত্ররা হাদিসের দরস নিতেন বা রেওয়ায়েত করতেন। মুফাসসির তাফসির করতেন। তার থেকে তাফসীর শিখতেন। কেউ নাহু-সরফ শিক্ষা দিতেন আর ছাত্ররা তার থেকে নাহু-সরফ শিখতেন। এটি ছিল প্রথম শিক্ষার সূচনার পর থেকে ধারাবাহিকতা।
ইতিহাস অনুসন্ধান করে এ তথ্য পাওয়া যায়- সব বিষয়কে এক সঙ্গে এক গণ্ডিতে শিক্ষা দেয়ার প্রথা চালু করেন সুলতান মুহাম্মদ গজনভী রহ. ৪১০ হিজরি মোতাবেক ১০২০ সালে। তিনি বড় একটি মসজিদ ও তার সঙ্গে একটি মাদরাসা তৈরি করেন। এরপর নেজামুল মুলক বাগদাদে একটি মাদরাসায়ে নেজামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। অতপর পর্যায়ক্রমে ভারতবর্ষে একের পর এক গড়ে উঠে কওমি মাদরাসা।
পরবর্তীতে ১৮৬৬ সালে ভারতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আমাদের দেশেও হাজারো কওমি মাদরাসা বিদ্যমান।
লেখক : পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ আশরাফবাদ, ঢাকা-১২১১
আইএইচ/

