মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো ইসলাম। এ ধর্ম আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক সময়ে মক্কার কাফেররা যখন সর্বশক্তি দিয়ে ইসলামের বিরোধিতা শুরু করে, তখন মুসলমানদের জন্য এক নিরাপদ ও শান্ত পরিবেশে দীনি শিক্ষা লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেই প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দারুল আরকামকে ইসলামের প্রথম কওমি মাদরাসা হিসেবে নির্ধারণ করেন। এখান থেকেই ইসলামের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দাওয়াতের প্রথম শক্তিশালী ধারা সূচিত হয়।
দারুল আরকাম প্রতিষ্ঠা : হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওতের দায়িত্ব পাওয়ার পর গোপনে দাওয়াত শুরু করেন। কয়েকজন সাহাবি একে একে ঈমান গ্রহণ করলে তাদেরকে দীনি শিক্ষা প্রদানের জন্য একটি নিরাপদ কেন্দ্রের প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই সময় হজরত আরকাম ইবনে আবিল আরকাম রা. তার বাড়ি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। এই বাড়িটি ছিলো মক্কার ‘সাফা’ পর্বতের পাদদেশে। শহরের ব্যস্ততা থেকে খানিকটা দূরে, তবে গোপন বৈঠকের জন্য উপযোগী জায়গা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে এই স্থানকেই দীনি শিক্ষা ও দাওয়াতের প্রথম কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণ করেন। ইতিহাসে এটি ‘দারুল আরকাম’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
দারুল আরকামের গুরুত্ব : আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি তোমার নিকট আত্মীয়দের সতর্ক করো।’ [সুরা শুয়ারা : ২১৪] এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে প্রকাশ্যে দাওয়াত শুরু করেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে গোপন পরিবেশে সাহাবিদের দীনি শিক্ষা দেওয়া ছিল অপরিহার্য। কোরআনের শিক্ষা, নামাজের বিধান, তাওহিদের বার্তা; সবকিছু প্রথমেই দারুল আরকামে শেখানো হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে ব্যক্তি, যে কুরআন শেখে এবং অপরকে শেখায়।’ [সহিহ বুখারি] এই হাদিসের আলোকে বলা যায়, দারুল আরকাম ছিল প্রথম কেন্দ্র যেখানে কুরআনের তিলাওয়াত, তাফসির, দীনি শিক্ষা ও আমল শেখানো হতো।
দারুল আরকামের কার্যক্রম : দারুল আরকাম মূলত তিনটি কাজের কেন্দ্র ছিল। এক. দীনি শিক্ষা : এখানে সাহাবিদের কোরআনের আয়াত মুখস্থ করানো হতো, নবুয়তের মিশন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হতো। দুই. আÍশুদ্ধি ও ঈমানের দৃঢ়তা : নতুন মুসলমানদের ধৈর্য, ত্যাগ ও আল্লাহর উপর ভরসার শিক্ষা দেওয়া হতো। তিন. দাওয়াত ও পরিকল্পনা : ইসলামের প্রসারের জন্য সাহাবিরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতেন।
দারুল আরকামের প্রথম ছাত্ররা : ইতিহাসে বর্ণিত আছে, দারুল আরকামে একত্রিত হওয়া সাহাবিদের সংখ্যা প্রায় চলি¬শজন ছিল। তাদের মধ্যে বিশিষ্ট হলেন, হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা., হজরত উসমান ইবনে আফফান রা., হজরত আলী রা., হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা., হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা., হজরত খালিদ ইবনে সাঈদ রা. এবং আরও অনেকে।
ইসলামের গোপন পাঠশালার প্রয়োজনীয়তা : মক্কার কাফেররা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালাতে শুরু করেছিল। এই পরিস্থিতিতে খোলাখুলিভাবে দীনি শিক্ষা দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। দারুল আরকাম সাহাবিদের জন্য এক আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায়। এখানে মুসলমানরা নামাজ আদায় করতেন, কুরআন শিখতেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে দাওয়াতের কৌশল শিখতেন এবং ঈমানের শক্তি অর্জন করতেন। এভাবে দারুল আরকাম ইসলামের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দারুল আরকামের প্রভাব : এক. ঈমানের দৃঢ়তা : এখানে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সাহাবিরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ঈমানে অটল ছিলেন। দুই. দাওয়াতের বিস্তার : এখান থেকেই সাহাবিরা বিভিন্ন গোত্র ও পরিবারে ইসলাম প্রচার করতেন। তিন. ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব : দারুল আরকাম মুসলমানদের জন্য একটি মিলনকেন্দ্র ছিল, যা তাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করে। চার. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্ব : পরবর্তী কালে ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
আধুনিক শিক্ষার জন্য দারুল আরকামের শিক্ষা : আজকের যুগে দারুল আরকাম মুসলমানদের জন্য এক অনন্য শিক্ষা দেয়। দীনি শিক্ষার জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইসলামি শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়; বরং আত্মশুদ্ধি ও আমলের কেন্দ্র। কঠিন পরিস্থিতিতেও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া জরুরি। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া ইসলামের দাওয়াত সফল হয় না।
প্রথম পাঠশালা : দারুল আরকাম শুধু একটি বাড়ি ছিল না; বরং এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পাঠশালা, প্রথম মাদরাসা, প্রথম দাওয়াতি কেন্দ্র। এখান থেকেই ইসলাম শক্তি সঞ্চয় করে মক্কার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এর গুরুত্ব অমূল্য। আজকের দিনে মুসলমানদের দীনি শিক্ষা, ঐক্য ও দাওয়াতি কার্যক্রমে দারুল আরকামের শিক্ষা এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
লেখক : মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর
আইএইচ/

